স্টাফ রিপোর্টার ॥ আজ থেকে শুরু হয়েছে মাহে রমজান। রোজা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, সাম্য, ত্যাগ ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় রোজা। এ ইবাদতের মাধ্যমেই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জন ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনেও সাওম বা রোজা অপরিহার্য ও অনিবার্য ইবাদত। মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধান, পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতি এবং সামাজিক সাম্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সাওম বা রোজার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়ত ঃ নিয়ত অর্থ মনের সংকল্প। আরবি বা বাংলায় উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরি নয় বরং মনে মনে নিয়ত করলেই চলবে। ফরজ রোজার নিয়ত ফজরের আজানের আগে করতে হবে।
সেহরি ঃ সেহরি খাওয়া সুন্নাত এবং এর অনেক ফজিলতও রয়েছে। তাই ক্ষুধা না থাকা সত্ত্বেও কিছু পরিমাণে খাবার খাওয়া উত্তম। তবে কেউ প্রবল নিদ্রার কারণে ঘুম থেকে উঠতে না পারলে শুধু নিয়ত করেই রোজা রাখা যাবে। সেহরি না খেলেও রোজা ছাড়া যাবে না।
ইফতারি ঃ সারা দিন রোজা রাখার পর রোজা শেষ করবেন ইফতারির মাধ্যমে। ইফতারি করা ওয়াজিব। মিষ্টিজাতীয় খাবার দিয়ে ইফতারি করা সুন্নাত। অন্য যেকোনো খাবার ও পানি দিয়েও ইফতার করা যাবে। খেজুর দিয়ে ইফতার করা উত্তম। কেননা আমাদের প্রিয় নবী সাঃ খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন।
ইফতারির নিয়ত ঃ আল্লাহুম্মা সুমতু লাকা ওয়া তাওয়াক্কালতু আলা রিজকিকা ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম। এরপর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে ইফতারি মুখে তুলবে।
কাজা ঃ কাজা হচ্ছে বদলি, অর্থাৎ কেউ যদি এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়ে তাহলে তাকে পরে সেই ওয়াক্ত পড়াকে কাজা বলে। তদ্রুপ যেসব কারণে রোজার কাজা করা যায়, সেসব ক্ষেত্রে তার জন্য অন্য দিন একটি রোজা রাখাই যথেষ্ট।
কাফফারা ঃ আর কাফফারা হচ্ছে একটির বদলে ৬০টি এবং ৬০টি রোজা একাধারে রাখতে হবে। যদি মাঝ থেকে একটি রোজা ছুটে যায় তবে আবার ৬০টি রোজা রাখতে হবে। তবে যদি ৬০টি রোজা একাধারে রাখতে সক্ষম না হয়, তাহলে ৬০ জন মিসকিনকে তৃপ্তি সহকারে দুই বেলা খাওয়াতে হবে, অথবা একজন মিসকিনকে ৬০ দিন দুই বেলা করে খাওয়াতে হবে। রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কিছু খেলে অথবা পান করলে তার ওপর রোজার কাজা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। রোজা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে দৈহিক মিলন ঘটলে তাদের ওপর রোজার কাজা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। অনিচ্ছায় পানি বা খাবার খেলে, গোসল বা অজুর সময় পেটে পানি চলে গেলে, ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তমৈথুন বা স্ত্রীকে স্পর্শ করার কারণে বীর্যপাত ঘটলে রোজা ভেঙে যাবে এবং তার কাজা আদায় করতে হবে; কিন্তু কাফফারা ওয়াজিব হবে না।
যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় ঃ কানে বা নাকে ওষুধ দিলে, ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভরতি করে বমি করলে বা অল্প বমি এলে তা গিলে ফেললে, কুলি করার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে কণ্ঠনালী পর্যন্ত পানি চলে গেলে, ধূমপান করলে, রোজা ভেঙে গেল মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে আবার কিছু খেলে, রাত আছে মনে করে সুবহে সাদিকের পর সেহরি খেলে, ইফতারের সময় হওয়ার আগেই সময় হয়ে গেছে মনে করে সময় হওয়ার আগেই ইফতার করলে, দুপুরের পর ফরজ রোজার নিয়ত করলে।
যেসব কারণে রোজা ভাঙে না ঃ মেসওয়াক করলে, চোখে সুরমা বা কোনো ওষুধ দিলে, খুশবু লাগালে বা তার ঘ্রাণ নিলে, গরম বা তৃষ্ণার কারণে গোসল করলে বা বারবার কুলি করলে, মুখে থুতু এলে এবং তা গিলে ফেললে, সাপ বা অন্যান্য পোকামাকড় কামড় দিলে, রোজা অবস্থায় দাঁত উঠালে কিন্তু রক্ত পেটে না গেলে, অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর ধোঁয়া, ধুলাবালি বা পোকামাকড় প্রবেশ করলে রোজা ভাঙে না।
কাজা রোজা ঃ রোজার কাজার মাসায়েলগুলো হলো- রমজানে রোজা কাজা হলে রমজান শেষ হওয়ার পর যথাশিগগির কাজা রোজা আদায় করে নিতে হবে। বিনা কারণে দেরি করা গুনাহ। যে কয়েকটি রোজা কাজা হয়েছে, তা একাধারে রাখা মুস্তাহাব। বিভিন্ন সময়েও রাখা যায়। কাজা রোজার জন্য সুবহে সাদিকের আগেই নিয়ত করতে হবে। অন্যথায় কাজা রোজা সহিহ হবে না। সুবহে সাদিকের পর নিয়ত করলে সেই রোজা নফল রোজা বলে গণ্য হবে। যদি একাধিক রমজানের রোজা কাজা হয়ে যায়, তবে নির্দিষ্ট করে নিয়ত করতে হবে- আজ অমুক বছরের রমজানের কাজা রোজা আদায় করছি। আর কেউ যদি নফল রোজা রাখার নিয়ত করে তবে তার জন্য উত্তম হচ্ছে, সে যেন কাজা রোজার নিয়ত করে। এতে নফলের নেকিও পেয়ে যাবে।
যেসব কারণে রোজা না রাখার অনুমতি আছে ঃ যদি কেউ শরিয়তসম্মত সফরে থাকে, তবে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে পরে কাজা আদায় করে নিতে হবে। রোগমুক্তির পর যে দুর্বলতা থাকে, তখন রোজা রাখলে যদি পুনরায় রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে পরে কাজা আদায় করে নিতে হবে।
কোনো রোগীর যদি রোজা রাখার কারণে রোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বা নতুন রোগ দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে বা রোগমুক্তি বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে।
নারীদের হায়েজ বা নেফাস অবস্থায় রোজা ছেড়ে দিতে হবে। তবে পবিত্র হওয়ার পর রোজা কাজা করে নিতে হবে।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয় কিন্তু ভাঙে না ঃ বিনা প্রয়োজনে কোনো জিনিস চিবালে। খাবার তৈরির সময় স্বাদ নিলে। তবে কোনো চাকরের মনিব বা কোনো নারীর স্বামী যদি বদমেজাজি হয় তাহলে জিহ্বার আগা দিয়ে লবণ চেখে তা ফেলে দিলে রোজা মাকরুহ হবে না। যেকোনো ধরনের মাজন, কয়লা, গুল বা টুথপেস্ট ব্যবহার করা মাকরুহ। গোসল করা ফরজ, কিন্তু এই অবস্থায় গোসল না করে সারা দিন থাকলে কোনো রোগীর জন্য নিজের রক্ত দিলে, ক্ষুধা বা পিপাসার জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করলে, ঝগড়াফাসাদ বা গালিগালাজ করলে, মুখে অধিক পরিমাণ থুতু একত্র করে তা গিলে ফেললে, গিবত করলে বা মিথ্যা বললেও রোজা মাকরুহ হয়ে যায়।
অনিচ্ছায় বা ভুলবশত কেউ রোজা অবস্থায় খাবার খেয়ে ফেললে পরে সে চিন্তা করল যে যেহেতু রোজা ভেঙেই ফেলেছি সেহেতু আজকে আর রোজা রাখবো না- এমনটি ঠিক নয়। ভুলে কিছু খেলে বা পান করলে রোজা নষ্ট হয় না, বরং যখনি তার রোজার কথা মনে পড়েছে তখন থেকেই সতর্ক থাকবে, যেন ইফতারের আগ পর্যন্ত এমনটি না হয়। আমাদের সব মুমিন মুসলমানের উচিত, আত্মশুদ্ধির ও গুনাহ মাফের মাস মাহে রমজানের কথা মাথায় রেখে সব ধরনের পাপকে বর্জন করা। আসলে যেসব পাপকাজে আমরা লিপ্ত হই, সেগুলো কিন্তু একদমই খনিকের সর্বোচ্চ এক মাসের রেশ আমাদের ভেতর থাকে। কিন্তু দেখুন, মৃত্যুর পর যে জীবন সেই জীবনের কিন্তু কোনো মৃত্যু নেই। তাই আসুন, একটু কষ্ট করে হলেও অন্তত এই মাসটিতে আমরা সব পাপ থেকে দূরে থাকি।