জালাল আহমেদ
কি আশ্বাস তারা পেয়েছিলেন জানি না তবে আত্মসমর্পণ করার পর সবাই হাজতে যায় ॥ এরপর শুরু হয় হৈ চৈ
বিয়ের পর কয়েকদিন চট্টগ্রামে থেকে আমি বাঁশখালী ফিরে গেলাম আর আমার স্ত্রী চাঁদপুরে। স্বভাবতই বিয়ে পরবর্তী এই বিচ্ছিন্নতা কষ্টদায়ক। পরের মাসে এপ্রিল ১৯৮৯ তে কুমিল্লা বার্ডে দুইদিনের একটা সম্মেলনে ডাক পেলাম। আমি বাঁশখালী থেকে একটা টয়োটা লাইটেস মাইক্রোবাস নিয়ে চাঁদপুরে গেলাম, পরদিন সকালে আমার স্ত্রীসহ বার্ডে এলাম। একরাত বার্ডে থেকে দু’দিনের সম্মেলন শেষে বিকেলে কুমিল্লা থেকে হবিগঞ্জ রওয়ানা হলাম। কারণ আমার আব্বা তখনো আমার স্ত্রীকে দেখেননি। এটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য কষ্টদায়ক ছিল। হবিগঞ্জে আব্বা আম্মা ছাড়া কেউ জানতেন না যে আমি সস্ত্রীক হবিগঞ্জ যাচ্ছি। হবিগঞ্জ গিয়ে হাজির হতে হৈ চৈ পড়ে গেল। আত্মীয়স্বজন যারা শহরে আছেন তাঁদের সবাইকে খবর দেয়া হল। দু’দিন হবিগঞ্জ থেকে আমার স্ত্রীকে চাঁদপুর নামিয়ে দিয়ে বাঁশখালী ফিরে এলাম। বিয়ের অনুষ্ঠানের তারিখ করা হল ২৬ মে ১৯৮৯। হবিগঞ্জ থেকে বরযাত্রী ২৫ তারিখে এসে একরাত চাঁদপুরে থেকে হবিগঞ্জ ফিরে গেল। বিয়েতে চট্টগ্রাম থেকে সোলায়মান ভাই এসেছিলেন আর ঢাকা থেকে সস্ত্রীক মুনির ভাই। যথাক্রমে ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ হতে এই দুইজন বন্ধু সুখে-দুঃখে আমার সংগে আছেন। তাঁদের উভয়ের কাছেই আমি ভিন্ন ভিন্ন কারনে কৃতজ্ঞ। তাঁরা এবং বরযাত্রীরা খাবার, বিশেষ করে ২৫ তারিখের চাঁদপুরের মাছের আপ্যায়নের কথা এখনো বলেন। এটা ছিল আমার শ্বশুরের স্বভাবজাত প্রকাশ, তিনি নিজে ভালো বাজার, ভালো খাওয়া দাওয়া পছন্দ করেন আর বিশেষ করে ভালো মাছ তাঁর খুবই প্রিয়। আব্বাসহ আমি ২৬ তারিখে চাঁদপুরে থেকে পরদিন ২৭ তারিখে হবিগঞ্জে ফিরলাম। থেকে যাবার কারণ ছিল আব্বা যেন অসুস্থ শরীরে একদিন বাড়তি বিশ্রাম পান আর পুরনো হাইওয়েতে সাতছড়ির অরণ্যে ডাকাতির ঝুঁকি এভয়েড করা। পরদিন ছিল মেঘলা দিন, পথে প্রচুর বৃষ্টি হল, কুকুর বিড়ালও লজ্জা পাবে, এমন। সেদিন থেকেই এখন পর্যন্ত আমার স্ত্রী মেঘ রাশি। আমার ছেলেরাও বলে যে তাঁদের মা’কে নিয়ে কোথাও যাওয়া মানে বৃষ্টি মাথায় যাওয়া, তা শীত গ্রীষ্ম যাই হোক! হবিগঞ্জ আসার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পদ্মা অয়েলের ডিপোতে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে হবিগঞ্জ পৌঁছাই। আনুষ্ঠানিকভাবে বধুবরণ শেষ হল। পরদিন যেতে হবে বাজারে, বউ এর জন্য ঘনপাতি মাছ নিয়ে আসতে হবে, বউ এর মাছ কাটার পরীক্ষা। পরদিন সকালে বাজারে গিয়ে “ঘইন্যা” মাছ নিয়ে এলাম। ঘইন্যা মাছ সাধারণতঃ এপ্রিল-মে মাসে পাহাড়ি ঢলের সময় নদীতে ধরা পড়ে। অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ তবে এর আঁশ ঘন এবং কাঁটাও বেশি। দাদী, মামী, আম্মা’র সামনে সবার উপস্থিতিতে এক আনন্দঘন পরিবেশে মাছ কাটার পরীক্ষা হয়ে গেল। এরপর হবিগঞ্জে বৌভাত বা রিসেপশনের প্রোগ্রাম হল আমাদের বাসার সামনেই, জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তখন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন ১৯৭৩ ব্যাচের হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী, তিনি হবিগঞ্জে তিন বছর ডিসি থাকার পর কুমিল্লা জেলাতেও তিন বছর ডিসি ছিলেন। পরবর্তীতে একই ব্যাচের আবু সোলায়মান চৌধুরীকে মন্ত্রীপরিষদ সচিব করার জন্য আবুল কাসেম ও হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরীকে রাষ্ট্রদূত করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আবু সোলায়মান চোধুরীর বাড়ি ছিল বাঁশখালী উপজেলায় এবং তখনই উনার সংগে আমার টেলিফোনে পরিচয় হয় এবং পরবর্তীতে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। অবশ্য সেটা ভিন্ন গল্প। অনুষ্ঠানের পর জুন মাসের শুরুতে আমার স্ত্রী ফারাহ দিবাকে নিয়ে বাঁশখালী চলে আসি। ইতোমধ্যে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে এক ঘটনা ঘটে। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ উল্লাহ বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন, বাড়ি চাঁদপুর। এর আগে শ্রম কল্যাণ কর্মকর্তা হিসাবে কোথাও কাজ করেছেন। তিনি আমার আসার আগে থেকেই বাঁশখালীতে ছিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সংগে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এ কারণে কোর্ট নিয়ে আমার একটা বাড়তি উৎকণ্ঠা থাকতো। এসব সম্পর্ক যে গুরুত্বহীন তা খুব ভালোভাবে প্রমাণ হল এ সময়ে। এক হত্যা মামলায় সব আসামীরা আত্মসমর্পণ করবে। তারা আগেই উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সম্ভবতঃ সংসদ সদস্যের মাধ্যমে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কি আশ্বাস তারা পেয়েছিলেন জানি না তবে আত্মসমর্পণ করার পর সবাই হাজতে যায়। এতে তাৎক্ষণিক এক হৈ চৈ পড়ে যায়। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ অন্যরা সংগঠিত হতে থাকে। একটু পরেই মাইকিং করে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে পরদিন সকালে বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে তাঁর বিরুদ্ধে জনসমাবেশের ডাক দেয়া হয়। আমি দ্রুত বিষয়টা জেলা প্রশাসককে জানাই, উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারির প্রস্তুতি নেই ও পুলিশ চেয়ে নিজে পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সংগে কথা বলি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন ১৯৭৯ ব্যাচের আনিসুর রহমান। তিনি অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপ নেন। পরদিন ভোরের মধ্যে এক ট্রাক পুলিশ চলে আসে ও বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়।
ঐদিন ছিল উপজেলা পরিষদের মিটিং। সবাই মিটিং রুমে, আমি যাচ্ছি না। ১৪৪ ধারা জারির কাগজ টাইপ করে আমার সামনে রাখা। উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি শিকদার এলেন হলরুম থেকে আমাকে নিতে। আমি বললাম এই অবস্থায়তো আমি যেতে পারি না, আমি ১৪৪ ধারা জারি করার জন্য প্রস্তুত, এই জনসভা হতে দেয়া যাবে না। তিনি বললেন যে আমি এই সভা বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি। আমি বললাম তাহলে কি আপনিই এই সভার ব্যবস্থা করেছিলেন নাকি? যাই হোক, বালিকা বিদ্যালয় মাঠের সভা বন্ধ হল।
এদিকে সংসদ সদস্য বিভাগীয় কমিশনারকে অনুরোধ করলেন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বদলীর জন্য। আমি বিভাগীয় কমিশনার আলী হায়দার খান এর সংগে দেখা করে তিনটি অনুরোধ জানালাম।
প্রথমত উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সংগত কারণ থাকলেও এখনই বদলী না করা ভালো হবে, না হলে পরবর্তী উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করতে পারবেন না।
দ্বিতীয়ত যখন বদলী করা হবে তখন তাঁকে ভালো কোথাও পদায়ন করতে হবে যাতে সংসদ সদস্যের লোকেরা বলতে না পারে যে তাঁকে এমপি সাহেব বদলী করিয়েছেন।
তৃতীয়ত সময় লাগলেও একজন ভালো ম্যাজিস্ট্রেট না পেলে এখানে পদায়ন করা যাবে না। বিভাগীয় কমিশনার আমার তিনটি অনুরোধই রাখলেন।
আহমেদ উল্লাহর পরবর্তী পদায়ন হল দুই মাস পর, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) হিসাবে সিলেট জেলায়। ৪ মাস অপেক্ষার পর এখানে পোস্টিং দেয়া হল আমার দেখা একজন সৎ ও দৃঢ়চেতা ম্যাজিস্ট্রেট ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের আজিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে। চাকুরীতে আসার আগে আজিম ছিল ঢাকা’র ফুটবলের প্রথম বিভাগ (এখনকার প্রিমিয়ার লীগ) লীগের একজন খেলোয়াড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। আজিম আসার পর আদালত নিয়ে আমাকে আর চিন্তা করতে হয়নি।
তবে মধ্যবর্তী ৪ মাস আমাকে আদালতে বসতে হয়েছে। আদালতে এক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৪৫ ধারার ভূমিবিরোধ নিয়ে শান্তিভংগের আশংকার এক মামলায়। শীলকূপ এলাকার এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ফৌজদারী কার্যবিধি ১৪৫ ধারায় এই মামলা করেন। মামলায় সাক্ষ্য প্রদানের সময় দালিলীক প্রমাণ হিসেবে জমিদারী কবুলিয়ত ও পাট্টার এক বাঁধানো খাতাও তিনি জমা দেন। এই খাতা দেখতে গিয়ে এক সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি হই। এই খাতায় জলদী-শীলকূপ ইউনিয়নদ্বয়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত পরিবারকে দেয়া কবুলিয়ত ছিল যাতে বছরে পাঁচ দিন, নাক ফোড়ানো, কান ফোড়ানো, ত্বকচ্ছেদন, বিবাহ ও মরণোত্তর জেয়াফতে শেখ মরতুজ আলী মিয়ার বাড়িতে ‘বেগার” খাটার কড়ার ছিল। অর্থাৎ এই শর্ত মেনেই সবাই তাঁদের কাছ থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে জমিদারী উচ্ছেদের আগে চাষের জমি গ্রহন করেছিলেন।