জালাল আহমেদ
প্রধানমন্ত্রী’র ভাইয়ের বাসায় বা বাড়িতে আমাদেরও কখনো কখনো খেতে হয়েছে

কিছুদিন পর ধর্মমন্ত্রী মওলানা মান্নান আসলেন উপজেলায়, জেলা প্রশাসক মহোদয়ও সফরসঙ্গী হয়ে আসলেন। উপজেলা পরিষদের হলরুমে সকল ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সভা। ওখানে আমাকে চমকে দিলেন সদর ইউপি চেয়ারম্যান কলিমুল্লাহ যার সংগে আমার তেমন জানাশোনা ছিল না। তিনি ৪৩ বছর একটানা চেয়ারম্যান সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, সবসময় লুঙ্গী পড়তেন, খালি পায়ে থাকতেন। তিনি মাইকে এসে বললেন যে শিক্ষার মান রক্ষার জন্যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের থাকা দরকার এবং এরপর সবাই একই সুরে কথা বললেন। জেলা প্রশাসক রাজী হলেন না। তখন সিদ্ধান্ত হল যে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম ৪ পেপার পরীক্ষা পর্যন্ত আমি ফরিদগঞ্জে থাকবো এবং তারপর চাঁদপুর এসে যোগদান করবো। তদানুযায়ী ১৪ জুলাই ১৯৮৭ আমি নেজারত ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে চাঁদপুরে যোগদান করি।
আমি ফরিদগঞ্জে থাকলেও চাঁদপুর এর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষুন্ন হয়নি। শুধু জেলা সদর বলেই নয়, প্রতি বৃহস্পতিবার আমি বিকেলে চলে আসতাম চাঁদপুর, দু’দিন ক্লাবে খেলাধুলা করে আবার রোববার সকালে ফিরে যেতাম। ফলে আবার পরিচিত পরিমন্ডলেই ফিরে আসলাম কিন্তু এখন এনডিসি হিসেবে। চাঁদপুর তখন এনডিসি’র জন্য বিজি স্টেশন কারণ জেলায় মন্ত্রী ছিলেন তিনজন। ফরিদগঞ্জে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী মওলানা আবদুল মান্নান, মতলবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মেজর জেনারেল শামসুল হক এবং সদরে প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। ফলে সপ্তাহান্তে কোন না কোন মন্ত্রী আসতেনই, কোন কোন সপ্তাহে তিনজনই আসতেন। জেলায় সার্কিট হাউস না থাকলেও এ নিয়ে বড় সমস্যা হত না। কারন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেলা সদরে খুব একটা আসতেন না। ধর্মমন্ত্রীও ফরিদগঞ্জে চলে যেতেন। প্রধানমন্ত্রী পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্টহাউজে উঠতেন, সালামী নিতে। খাওয়া দাওয়া বেশিরভাগ তাঁর ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরীর বাসায় অথবা চাঁদপুর পুরান বাজারে নিজ বাড়িতে। আর তিনজন মন্ত্রীই ছিলেন বিবেচক ফলে বড় ধরনের কোন সমস্যা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী’র ভাইয়ের বাসায় বা বাড়িতে আমাদেরও কখনো কখনো খেতে হয়েছে। অবশ্যই ঐসব দিনে প্রধানমন্ত্রী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, কোনদিন খাবার তুলে দিয়ে আমাদের খাইয়েছেন। অসাধারণ এক মানুষ ছিলেন তিনি। একটি বইয়ে লেখক তাঁকে প্রশ্ন করছেন যে ‘আপনাদের পাশে এত খারাপ লোক ঘুরে বেড়ায় কেন?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘ভালো লোকেরা একদিন শীতল ব্যবহার পেলেই পরদিন আর আসবে না, আর এরা লাথি ঝাঁটা খেলেও যাবে না!’। তাই তারা টিকে থাকে। পরে যখন ড. আকবর আলী খান গ্রেশামস’ল দিয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসকে ব্যাখ্যা করে বই প্রকাশ করলেন তখন বিষয়টি আরো স্পষ্ট হল, ‘ব্যাড অফিসারস ড্রাইভস অ্যাওয়ে গুড অফিসারস আউট অফ পজিশনস টু সার্ভ’! চাঁদপুর সদরের উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মাস্টার এবং পৌরসভার চেয়ারম্যান শামস উদ্দিন ছিলেন তাঁর সবসময়ের সঙ্গী, দুজনেই বুদ্ধিদীপ্ত এবং মজার মজার গল্প হত একসঙ্গে হলেই।
পুলিশ সুপার ইফতেখার উদ্দিন ছিলেন সুপার একজন মানুষ এবং পেশাদার পুলিশ। আমার চাঁদপুর দুই বছর অবস্থানকালে প্রায় প্রতি সন্ধ্যা বা রাতে পুলিশ সুপার জেলা প্রশাসকের বাংলোতে আসতেন। আমি এনডিসি এবং ব্যাচেলর, ফলে এমন অধিকাংশ সাক্ষাতেই আমি উপস্থিত থাকতাম। আমি এর আগে চাঁদপুর ক্লাবের কথা উল্লেখ করেছি। খেলাধুলার সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত ভালো মানের একটি ক্লাব ছিল। আমি সেখানে নিয়মিত জেলা প্রশাসকের সংগে ব্যাডমিন্টন, এরপর টেনিস খেলে স্কোয়াশ খেলতে যেতাম। স্কোয়াশের পর বিশ্রাম, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে এরপর বিলিয়ার্ড খেলতাম। কার্ড রুমে আমার যাতায়াত ছিল না। কার্ড রুম কখনো কখনো সারারাতও খোলা থাকতো। ডাক্তার নুরুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম সদস্য। জেলা সদরে তিনি ছিলেন ব্যস্ততম ডাক্তার, অত্যন্ত ভালো প্র্যাকটিস। তিনি একই সংগে সমাজসেবার সংগে যুক্ত ছিলেন, একটিভ রোটারিয়ান, দেশে বিদেশে রোটারী সম্মেলনে অংশ নিতেন। পড়–য়া ছিলেন, তাঁর বাসায় বইয়ের ভালো সংগ্রহ ছিল। চেম্বার আর বাসায় যাওয়া আসার পথেও রিক্সায় বসেও তাঁকে বই খুলে পড়তে দেখেছি। তবে আমাকে চমৎকৃত করেছিল ১৯৮৮ সালে তাঁর সিউল অলিম্পিক দেখতে যাওয়া। পরে ভাবীদের অভিযোগে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে রাত ১২ টায় কার্ড রুম বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়।
চাঁদপুর স্টেডিয়ামে নিয়মিত খেলাধুলা হত। জেলা ক্রীড়া সংস্থা ছিল অত্যন্ত একটিভ। মুনির আহমেদ ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৪ ব্যাচের আতাউল হক স্টেডিয়ামে খেলাধুলা’র বিষয়টা সমন্বয় করতেন। ঐ সময় শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল এর আঞ্চলিক পর্যায়ের খেলা হয় চাঁদপুরে। সকলের সমন্বয়ে সাফল্যের সংগেই টুর্নামেন্ট শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু সিলেট-চাঁদপুর খেলায় দর্শকদের মধ্যে হাঙ্গামা হয়। আমিও ঐদিন প্যাভিলিয়নে ছিলাম। মহকুমা যুগে প্রাক্তন সিএসএস আখতার হোসেন খান ছিলেন এখানে মহকুমা প্রশাসক। ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি মুনির আহমেদ উনার কথা সব সময়ই বলতেন। আখতার হোসেন খান এর সময় চাঁদপুর এর ক্রীড়াঙ্গন সব সময় সরগরম থাকতো। উনার সময়ে এখানে জাতীয় ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। উনি পরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদেও ছিলেন এবং সরকারের সচিব হিসাবে অবসরে যান।
শীতের শুরুতেই হয় বিভাগীয় কমিশনার কনফারেন্স। এটা ছিল এক বিশাল আয়োজন। অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের ১৫ জেলার জেলা প্রশাসকদের এই সম্মেলন আমরা আয়োজন করি। এর আগের সম্মেলন হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, সেখান থেকে অভিজ্ঞতা ধার নেই। আমি নিজেও কথা বলি ব্রাহ্মণবাড়িয়া’র তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে। মেঘনার পাড়ে চাঁদপুরে নৌবিহারেরও ভূমিকা ছিল। একদিনের সেশন হয় বড় লঞ্চে, নৌবিহারসহ সম্মেলন ও পরিবারের সদস্যদের জন্য পিকনিকের আয়োজন করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার আলী হায়দার খান নিজে দরবারী মেজাজের মানুষ ছিলেন ফলে উনার উৎসাহে অত্যন্ত ভালো একটা সম্মেলন আমরা আয়োজন করেছিলাম।
সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে চাঁদপুর ছিল একটি অগ্রসর জেলা। অজয় কর ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সম্পাদক এবং সকল অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রাণ। নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। তবে ভালো হলের অভাব ছিল।
কালীবাড়ি মোড়ের কাছে যে হল ছিল সেটার আসন বিন্যাস ভালো ছিল না এবং কোন খোলা প্রাঙ্গণও ছিল না যেখানে এধরনের অনুষ্ঠান করা যায়। এনডিসি হিসাবে যে কোন জাতীয় বা বড় অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বা তাঁদের স্ত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ ছিল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। শিল্পকলা একাডেমী ভবনে একটা ছোট হল ছিল সেখানে ছোট ছোট প্রোগ্রাম করা হত। ঐ সময়ে উদ্যোগ নেয়া হয় চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী করার। জোড়পুকুর পাড়ে একটি জায়গাও পাওয়া যায়, সেখানেই একটি ভবন নির্মাণ করা হয় এবং তা উদ্বোধন করা হয়। সাহিত্য একাডেমীর বিস্তারিত একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সংগে আমি যুক্ত ছিলাম। এর অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন কবি অধ্যাপক খোরশেদ আলম। সাহিত্য একাডেমী থেকে একশত কবির কবিতা নিয়ে ‘শত মাল্লার জলতরংগ’ নাম দিয়ে একটি কাব্য সংকলন ও প্রকাশ করা হয়।
কালীবাড়ি মোড়ের কাছেই যে ভবনে মহিলা কলেজের ছাত্রী হোস্টেল ছিল সে ভবন চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতিকে দেয়া হল ডায়াবেটিক হাসপাতাল করার জন্য। ডাঃ আবদুল গফুর ছিলেন চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি, এর সঙ্গে এম এ মাসুদ ভূঁইয়া, মোশতাক হায়দার চৌধুরী, সুভাষ সাহাসহ অনেকে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত উদ্যোগী ছিলেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতি হাসপাতাল কাজ শুরু হয়। কিছুদিন পর চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতি বিষ্ণুদি এলাকায় জমি কেনে। সেখানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল সোসাইটি ফর ব্লাইন্ডস (বিএনএসবি) একটি চক্ষু হাসপাতালও করে যার সঙ্গেও মাসুদ ভূঁইয়া জড়িত ছিলেন। তাঁর বাবা মাজহারুল হক ভুইয়া’র নামে সেই হাসপাতালের নামকরণ করা হয়। চাঁদপুরের জনসেবামূলক কাজের সংগে যুক্ত এই সমাজসেবা চক্রের ব্যক্তিরা ছিলেন অত্যন্ত উদ্যোগী ও দক্ষ। তাঁদের নিয়ে আমরা অনেকগুলো কাজই করতে সমর্থ হয়েছিলাম। অনেক পরে ফরিদপুর জেলায় এরকম তুলনীয় একদল সংগঠকের দেখা পাই আমি।