জালাল আহমেদ
সুবিচার করতে হলে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ৫শ’র বেশী মামলা থাকা উচিত নয়

এর আগে উল্লেখ করেছিলাম যে এপ্রিল মাসে আমার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পদায়ন হয় পানছড়িতে। আমারও যাবার আগ্রহ ছিল না আর জেলা প্রশাসকও ছাড়লেন না তাই আমি খাগড়াছড়িতেই কাজ করছিলাম। এরমাঝে মে মাস পার হয়ে গিয়েছে, পাহাড়ে বর্ষা শুরু হয়েছে। পানছড়ি উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদানের জন্য আমাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয় ১৫ জুলাই ১৯৮৪। তখন আমাকে ১৪ জুলাই তারিখে অবমুক্ত করে একটি আদেশ জারি করা হয়। অবমুক্ত আদেশ অনুযায়ী আমাকে ২২ তারিখে পানছড়িতে যোগদান করতে হবে। সে সময়টা ভরা বর্ষা আর পানছড়ি যাবার রাস্তা প্রায় বন্ধ। চেঙ্গী নদীপথে স্থানীয় লোকজন বাধ্য হয়ে চলাচল করে কিন্তু তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণ নদীপথে কোন রুট প্রটেকশন থাকে না। বিভিন্ন কর্মকর্তার নদীপথে বা ঝিরিপথে চলার বেশ কিছু খারাপ অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানতাম।
আমি কথা বললাম আধুনালুপ্ত বিডিআর ২৪ রাইফেলস এর সিও মেজর সোলায়মানের সঙ্গে। তাঁর পানছড়ি যাবার প্রোগ্রাম আছে এবং আমি তাঁর সঙ্গে যেতে পারবো বলে জানালেন। এরপর অপেক্ষা, ২২ থেকে শুরু করে কোনদিনই সড়ক যাবার উপযুক্ত হয় না। অবশেষে ২৯ জুলাই যাবার মতো অবস্থা হলো, বৃষ্টিহীন দিন, কিন্তু রাস্তাঘাট সব তখনো ভেজা। আমরা যাত্রা শুরু করলাম এবং ১৬ মাইল রাস্তা যেতে বিডিআর সিও’র ল্যান্ডরোভার জীপে পুরো ৪ ঘন্টা লাগলো। রাস্তা কাঁচা সেটা বিষয় না, বিষয় হলো মাটি, পিচ্ছিল নরম মাটি, গাড়িতে কোথাও ব্রেক ধরলে গাড়ি ৪৫/৯০ ডিগ্রী ঘুরে যায়, আবার সাবধানে গাড়ি এলাইন করে এক্সেলেটরে পা। এর আগে যখন পানছড়ি আসি ধুলি ধুসরিত সেই রাস্তার সঙ্গে এই রাস্তার বিন্দুমাত্র মিল ছিল না আর উপরের ধুলার স্তরের পুরোটাই ‘মুভিং’ কাদার স্তরে রুপান্তরিত হয়ে গেছে। এভাবেই এঁকে বেঁকে কোথাও আটকে যাওয়া গাড়ি বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করে উদ্ধার, এভাবেই একসময় এ পথের শেষ হয়। আমি পানছড়ি এসে পৌঁছাই, যোগদান পানছড়ি উপজেলার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। পানছড়ি’র প্রথম ‘উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ ছিলেন আসাদুল ইসলাম, (সার্কেল অফিসার থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত), বাড়ি ছিল কুমিল্লা। তিনি অল্প কিছুদিন থেকে বদলী হয়ে চলে যান। পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট না আসা পর্যন্ত ঘধুরস ঈযড়ফিযঁৎু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রদত্ত ১৯০ ‘এ’ ‘বি’ পাওয়ার নিয়ে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ চালিয়ে নেন।
পানছড়ি উপজেলা পরিষদ ছিল একটি এলশেপ লম্বা টিনশেড বিল্ডিং এ। এর পেছনের টিনশেড ইউএনও কোয়ার্টার, সংলগ্ন অন্য অফিসারদের টিনশেড কোয়ার্টার। অফিসার্স কোয়ার্টারগুলোর পেছনে পূর্বপাশে চেংগী নদী। ইউএনও কোয়ার্টারের পেছনে, উত্তরে নির্মাণাধীন উপজেলা পরিষদের নন-গেজেটেড কর্মকর্তাদের বাড়ি। ইউএনও কোয়ার্টারের দক্ষিণে একটা প্রাকৃতিক নীচু এলাকা। তারও দক্ষিণে আরেকটি টিলা। পূর্বপাশে নদীর দিকে বাঁধ দেয়াতে এটা একটা ছোট লেকে রূপান্তরিত হয়েছে। লেকের দক্ষিণ পাড়ে নির্মাণাধীন গেজেটেড অফিসার্স কোয়ার্টার। উপজেলা পরিষদ মাঠের দক্ষিণ পাশে একটা টিনশেডে ইম্প্রোভাইজড উপজেলা আদালত। ইউএনও তখনো মোঃ রফিক উদ্দিন মোল্লা, ১৯৬৩ ব্যাচের ইপিসিএস২, ভালো অফিসার, ভালো মানুষ। তিনি আমাকে তাঁর বাসাতেই থাকতে বললেন। তিন বেডরুমের টিনশেডের একটাতে তিনি থাকেন, একটাতে আমি উঠলাম। আর আমার জন্য রুম ছেড়ে সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথমে ভেতরের একটা রুমে, পরে তাঁর বিয়ের পরে অন্য একটা টিনশেড কোয়ার্টারে চলে যান।
মেজর সোলায়মান আমাকে নামিয়ে উনার বিওপি ভিজিটে চলে গেলেন। আমি ঐদিন দায়িত্ব গ্রহন করি ও মামলাগুলো বুঝে নেই। সে সময়ে পানছড়ি উপজেলা আদালতে মামলা ছিল ২৪ টা। অথচ পরে আমি যখন মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম তখন আমার কোর্টে মামলা থাকতো ১৫০০ এর মতো। আর আমি যখন চীফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা তখন আমার এমএমদের কোর্টে মামলা থাকতো ২০০০/২২০০। আমি সবসময় বলতাম যে সুবিচার করতে হলে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ৫০০ এর বেশী মামলা থাকা উচিত নয়। যে সব মামলার তারিখ পার হয়ে গিয়েছে সেগুলোর নতুন করে তারিখ দিচ্ছিলাম ১৫ দিন পরে। আমার পদায়নে সবচেয়ে বেশী খুশি হয়েছিল থানার পুলিশ, কোর্ট পুলিশ ও কোর্ট স্টাফ। তাদেরকে নথিপত্র আসামী নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে আর খাগড়াছড়ি যেতে হবে না। এদিকে খাগড়াছড়ি জেলার বর্ষপূর্তি এগিয়ে আসতে থাকে, ৭ নভেম্বর, ১৯৮৪। কিছুদিন পর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি গঠিত হয় এবং বর্ষপূর্তি স্মরণিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। জেলা প্রশাসক মহোদয় আদেশ করেন যে আমি যেন জেলা সদরে থেকেই এই দায়িত্ব পালন করি। এই দায়িত্ব পেয়ে আমি আবার আমার পুরনো আস্তানায় ফিরে আসি।