বেতন না পেয়ে ১৩ শিক্ষক-কর্মচারীর মানবেতর জীবন ॥ অধ্যক্ষ জামালকে ইউএনও’র শোকজ
নিজস্ব প্রতিনিধি ॥ বাহুবল উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী কিশলয় জুনিয়র হাই স্কুলের ১৩ শিক্ষক কর্মচারী ৪ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত ২৭ বছরের পুরাতন এ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে পর্যাপ্ত অর্থ কেন থাকবে না- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নিগ্ধা তালুকদার রেকর্ড-পত্র পর্যালোচনা করেন। এতে বেরিয়ে আসে তহবিল তছরুপ, অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। এ প্রেক্ষিতে তিনি গত ১৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ জামাল আহমেদকে ৭ কর্মদিবসের (২৭ অক্টোবর) মধ্যে লিখিত জবাব দিতে নোটিশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সনে বাহুবল উপজেলা পরিষদ এলাকার ভেতর সরকারি অবকাঠামো ব্যবহার করে “কিশলয় কিন্ডারগার্টেন” নামে একটি আধুনিক শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে “কিশলয় জুনিয়র হাইস্কুল” নামকরণ করা হলেও পাঠদান হয় প্লে থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। উপজেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। বিগত ২০১৩ সন থেকে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জামাল আহমেদ। গত বছর ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসফরে নিয়ে সুইমিংপুলে ছাত্রীদের সাথে জলখেলীর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হলে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এর কিছুদিন পর ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা এ সমালোচনা আরো গতিময় করে। শেষমেষ বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠন হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে, চলতি বছর মার্চ মাসে দেশে করোনা ভাইরাস বিস্তার ঠেকাতে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে কিশলয় জুনিয়র হাই স্কুলও ছুটির ফাঁদে পড়ে। ছুটি শুরুর ২ মাসের মাথায় ব্যাংকে টাকা না থাকার অযুহাতে বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেন অধ্যক্ষ জামাল আহমেদ। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নিগ্ধা তালুকদারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি অধ্যক্ষ জামাল আহমেদ-এর হাতে অবৈধভাবে মজুদ থাকা টাকা আদায় করে শিক্ষক-কর্মচারীদের ২ মাসের বেতন ও উৎসব ভাতা প্রদান করেন। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র তলব করে তা পর্যালোচনা করেন। এতে মোটা অংকের তহবিল তছরুপ, অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র বের হয়ে আসে। এ প্রেক্ষিতে তিনি অধ্যক্ষ জামাল আহমেদকে গত ১৫ অক্টোবর শোকজ করেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, তহবিল তছরুপ, অপচয় সংক্রান্ত ১৩টি এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানুয়ালের বিভিন্ন ধরা লংঘন করে অনিয়ম-দুর্নীতি সংগঠনের ৭টি সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করে নোটিশে জবাব চাওয়া হয়েছে।
কিশলয় জুনিয়র হাই স্কুলের নামীয় ব্যাংক হিসেবে ৭ লক্ষ ৭৯ হাজার ৯৮৬ টাকা থাকার কথা থাকলেও গচ্ছিত আছে মাত্র ২৩ হাজার ৫৪৪ টাকা। বাকী টাকার হদিস জানতে চাওয়া হয়েছে প্রেরিত নোটিশে। এছাড়া অনুমোদনবিহীন মোটা অংকের টাকা খরচ, বাজেট ছাড়া লাগামহীন খরচ, ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন না করে নগদ লেনদেন এবং ভর্তি ফরম বিক্রির অর্থ, কোচিং-এর আয়ের অংশ, মডেল টেস্টের আয় ও বই, আইডি কার্ড, সিলেবাস, টাই, ব্যাজ, সোল্ডার বিক্রির আয় তহবিলে অন্তর্ভূক্ত না করার কারণও নোটিশে জানতে চাওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সনে প্রতিষ্ঠানের আংশিক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ায় বছর শেষে ব্যাংক প্রায় ১৩ হাজার টাকা সুদ প্রদান করে। পরবর্তী বছরগুলোতে ব্যাংক লেনদেন না হওয়ায় ৭ বছরেও উক্ত পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়নি। ২০১৩ সনের পর প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংখ্যা ও বিভিন্ন প্রকার ফি বাড়ায় বছরে লেনদেন অনেক বাড়ার কথা। এ হিসেবে গত ৭ বছরে কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা ব্যাংক সুদ প্রাপ্তি থেকে প্রতিষ্ঠানটি বঞ্চিত হয়েছে।
প্রতি বছর তিনটি করে মডেল টেস্ট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি মডেল টেস্টের জন্য যে পরিমাণ পরীক্ষা ফি আদায় হয় তাতে খরচ বাদে গত ৭ বছরে কমপক্ষে ৪ লক্ষ টাকা আয় হওয়ার কথা থাকলেও এ খাতে কোন প্রকার অর্থ তহবিলভূক্ত করা হয়নি।
অর্ধেকমূল্যে কেনা কেজি লেভেলের বই পূর্ণমূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিক্রি করা হয়। এ খাতে গত ৭ বছরে কমপক্ষে সাড়ে ৩ লাখ টাকা আয় হলেও তাও তহবিলভূক্ত হয়নি।
এছাড়া, গত ৭ বছর ভর্তি ফরম, সিলেবাস, খাতা, আইডি কার্ড, টাই, ব্যাজ, সোল্ডার ইত্যাদি বিক্রি থেকে আরো অন্ততঃ আড়াই লাখ টাকা আয় হয়। তাও তহবিলভূক্ত হয়নি।
প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্রটি দাবি করেছে, উল্লেখিত খাতের আয়সমূহ তহবিলভূক্ত না করার মধ্যমে অন্ততঃ ১০ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com