মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জের রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস
মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জের রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জের বীর সেনানীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে রাখেন অসামান্য অবদান। সম্মুখ সমরে সিলেট বিভাগের প্রথম শাহাদাতবরণকারী মুক্তিযোদ্ধা শায়েস্তাগঞ্জের কৃতি সন্তান। তাই এই ইতিহাস শায়েস্তাগঞ্জবাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
মুক্তিযুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান প্রসঙ্গে শায়েস্তাগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোঃ আব্দুর রকিব বলেন- মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে হবিগঞ্জ জেলার নবগঠিত শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাতের ঘটনা জানার পর ২৬ মার্চ থেকে হবিগঞ্জে প্রতিরোধ দূর্গ তৈরীর কাজ শুরু হয়। ব্রিগেডিয়ার চিত্ত রঞ্জন দত্ত, জেনারেল এমএ রব, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীসহ হবিগঞ্জের আপামর জনতা সিলেটকে মুক্ত করার প্রস্তুতি নেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান জেনে সিআর দত্ত ওরফে চিত্ত রঞ্জন দত্ত’র নেতৃত্বে হবিগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজার গিয়ে ক্যাম্প করেন। এর কারণ সেখান থেকে সিলেট আক্রমণ করা সুবিধাজনক। পাকিস্তানী সৈন্যরা সিলেট থেকে সড়ক পথে কুমিল্লা বা বি-বাড়িয়া যেতে হলে তাদেরকে মৌলভীবাজার হয়ে যেতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে শত্রুদের বেছে নিতে হবে শেরপুর-সাদিপুর সড়ক। তখন শায়েস্তাগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করার জন্য শেরপুর-সাদিপুর প্রেরণ করেন। এই দলে ছিলেন শায়েস্তাগঞ্জের মোঃ হাফিজ উদ্দিন ও মোঃ মফিল হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে শেরপুর বাংকার থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। দফায় দফায় যুদ্ধ করার পর ১৪ এপ্রিল সাদিপুর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন শায়েস্তাগঞ্জের কৃতি সন্তান মোঃ হাফিজ উদ্দিন ও মোঃ মফিল হোসেন। তারাই হলেন বৃহত্তর সিলেটের প্রথম দুই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সম্মুখ সমরে মোঃ হাফিজ উদ্দিন ও মোঃ মফিল হোসেন শহীদ হওয়ার পর কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর গাড়িতে করে তাদের লাশ শায়েস্তাগঞ্জে আনা হয়। সাদিপুর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ মোঃ মফিল হোসেন তৎকালীন বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড শাহজীবাজারের সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। আর শহীদ মোঃ হাফিজ উদ্দিন ইস্ট বেঙ্গল মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট কুমিল্লাতে চাকুরি করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হাফিজ উদ্দিন ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। ছুটিকালীন সময়েই তিনি যুদ্ধে অংশ নেন। সম্মুখ সমরে সিলেট বিভাগের প্রথম শাহাদাতবরণকারী মোঃ হাফিজ উদ্দিন ও মোঃ মফিল হোসেন শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার পূর্ব বড়চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে চিরশায়িত। শায়েস্তাগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোঃ আব্দুর রকিব এই দুই বীর শহীদকে নিয়ে গর্ববোধ করেন।
এছাড়া ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে শায়েস্তাগঞ্জের পার্শ্ববর্তী লালচান্দ চা বাগান থেকে ১১ জন চা শ্রমিককে ধরে এনে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশনের পূর্ব পাশে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। তাদেরকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় গুলি করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হবার আগেই পাক হানাদার বাহিনীর নির্দেশে তাদের মাটি চাপা দেয়া হয়। যে স্থানে তাদের হত্যা করা হয়েছিল সে স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। আজও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সেই নৃশংসতার কথা স্মরণ করে নিরবে অশ্রু ফেলেন নিহতদের স্বজনরা। যাদেরকে পাকিস্তানী হানাদাররা হত্যা করে তারা হলেন- লাল চান্দ চা বাগানের কৃষ্ণ বাউরী, রাজেন্দ্র রায় বাউরী, গহর রায় বাউরী, নেপু বাউরী, রাজকুমার গোয়ালা, বিপক বাউরী, সুনিল বাউরী, ভুবন বাউরী, মহাদেব বাউরী, লাল সাধু ও আনু মিয়া।