জালাল আহমেদ
আমি ও আব্বা একই তারিখে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করি ॥ আমাদের জন্য এটা আজীবন এক গর্বের বিষয়

আমাদের মৌখিক পরীক্ষার ডাক পেলাম, আমার ২৮ মার্চ ১৯৮৩ আর আব্বার ১২ এপ্রিল ১৯৮৩ তারিখে, স্থানঃ চামেরী হাউস, ১৭ তোপখানা। তখনকার পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিস, বর্তমানে সিরডাপ ভবন, প্রেস ক্লাবের পাশে। আমার মৌখিক পরীক্ষা হয়ে গেলো যথাসময়ে এবং প্রত্যাশামত ভালোই হয়েছিল। এপ্রিলের শুরু থেকে আমার লোক প্রশাসনে মাস্টার্স এর ক্লাশও শুরু হয়ে যায়। আব্বার মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে প্রধান ছিলেন জনাব ফয়েজ উদ্দিন আহমদ, তৎকালীন চেয়ারম্যান, পিএসসি। মৌখিক পরীক্ষায় সন্তানদের বিষয়ে প্রশ্ন আসলে আব্বা স্বভাবতই আমিও বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি তা’ উল্লেখ করলেন। চেয়ারম্যান প্রশ্ন করলেন, “আপনার ছেলে যদি নিয়মিত ব্যাচে পাশ করে তাহলে তো সে আপনার সিনিয়র হবে, কোন না কোন স্টেশনে আপনাকে তার অধীনেও কাজ করতে হতে পারে?” আব্বার জবাব ছিল, “আমাকে তো কারো না কারো ছেলের অধীনে কাজ করতেই হবে, নিজের ছেলের অধীনে করতে বাধা কোথায়?” আব্বা পরীক্ষা দিয়ে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন এবং সবাইকে মজা করে মৌখিক পরীক্ষার গল্প করছিলেন।
এদিকে আমার সামনে ছিল বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত এর মৌখিক পরীক্ষা। কারণ বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ এর মৌখিক পরীক্ষার আগেই বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত’র লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল। যাতে ধারনা অনুযায়ী আমি উত্তীর্ণ হই। তারপর ছিল ১০০ নাম্বারের মানসিক অভিক্ষা বা সাইকোলজিকাল টেস্ট। আমার ক্ষেত্রে এই টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। বুকে পিঠে নাম্বার দেয়া জ্যাকেট পরিয়ে একটা দলের সঙ্গে গোল করে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল কিছু সমস্যা আর দলীয় কাজ দিয়ে। এরপর মৌখিক পরীক্ষা পিএসসি দপ্তরে, চামেরী হাউসে। আমার বোর্ডে উভয় মৌখিক পরীক্ষাতেই কে কে ছিলেন আমার জানা ছিল না বা জানা নেই। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব ও সুচনা প্রশ্নের পর স্বভাবতই জিজ্ঞাসা হলো যে আমি কেন অনার্স দিয়েই বিসিএস দিচ্ছি। আমি বললাম যে ছোটবেলা থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল সিভিল সার্ভিসে আসার তাই যেহেতু সুযোগ পেয়েছি এবং যোগ্যতা আছে তাই পরীক্ষা দিয়েছি। তারপর প্রশ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার কেনো? এই প্রশ্নটা প্রায় সবাইকেই করা হয়ে থাকে এবং এর সাধারণ জবাবও আছে। অনেকেই বলে থাকেন দেশের মানুষের সেবা করার জন্য। আমি বললাম যে আমার যে উপযুক্ততা আছে আমি মনে করি প্রশাসন সার্ভিসের মাধমে এর সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব হবে, আর যোগ করলাম ছোট বেলা থেকে আমার মানসিক প্রস্তুতির কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে আমি কোন বিষয়ে ভালো বা আমাকে কোন বিষয় থেকে প্রশ্ন করবেন? আমি বললাম যে আমার পাঠ্য বিষয় ছাড়া যে কোন বিষয়ে। অদ্ভুত জবাব! আমাকে তখন দুটো প্রশ্ন করা হয়েছিল আমার পাঠ্য বিষয় লোক প্রশাসন থেকে। আমার মনে নেই কি প্রশ্ন ছিল তবে খুব কঠিন কিছু ছিল না আর আমি নিজে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট ছিলাম না। এরপর শুরু হল পাঁচমিশালী প্রশ্ন যাতে অন্তত ঐ সময়ে আমাকে আটকানো ছিল খুব কঠিন। ৩৫ মিনিটের বেশী ছিল আমার মৌখিক পরীক্ষা যা বিশেষ ব্যাচ এর সময় ছিল ২০ মিনিট এর মতো। আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে আমি এতে পাশ করবো।
আমি দুটো বিসিএস এর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর আশা করছিলাম যে নিয়মিত বিসিএস এর ফলাফল যেন আগে বের হয়। কিন্তু তা হল না। ৫ মে ১৯৮৩ বিসিএস (১৯৮২ বিশেষ) এর ফল প্রকাশিত হলো এবং চূড়ান্ত ফলাফলে আব্বা এবং আমি দুজনেই উত্তীর্ণ হলাম। পরিবারের সবার জন্যই এটা ছিল একটা আনন্দের উপলক্ষ। যদিও আমি নিয়মিত বিসিএস এর ফলাফলের অপেক্ষায় থেকে খুব একটা উৎফুল্ল হতে পারিনি। একমাস পর ৫ জুন ১৯৮৩ আমাদের অফার অফ এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হলো তখনো নিয়মিত বিসিএস এর ফল প্রকাশিত হয় নাই। অফারে আমাদের ১৯ জুন ১৯৮৩ তারিখে চাকুরীতে যোগদানের কথা বলা হলো। আমাকে সিভিল অফিসার ট্রেনিং একাডেমী (কোটা) তে আর আব্বাকে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন (নিপা) তে। মেধা তালিকা অনুযায়ী প্রথম ১৫০ জন কোটা, দ্বিতীয় ১৫০ জন নিপা, ৬২ জন আইন স্নাতক নিপাতে যোগদানের আহ্বান পায়। পরে নিপাতে আরেকটি ব্যাচ এবং স্টাফ ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে (এসটিআই) একটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ হয়।
বিশেষ ব্যাচে যোগদানের ইচ্ছা আমার ছিল না কারণ আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে নিয়মিত ব্যাচে আমি উত্তীর্ণ হব। আমার চাচা বললেন বিশেষ ব্যাচ সামরিক শাসকের কর্মসূচী বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ফলে নিয়মিত ব্যাচের ফলাফল কবে হবে তার ঠিক নেই। আগে যোগদান করো পরে তো বদলানোর সুযোগের কথা অফারেই বলা আছে। ফলে আমার সিদ্ধান্ত বদলালাম। ১৯ জুন ১৯৮৩ তারিখে আমি ও আব্বা একই সঙ্গে চাচার বাসা থেকে বের হয় দু’জন দুই প্রতিষ্ঠানে একই তারিখে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করি। আব্বার জন্য এবং আমার জন্যও এটা ছিল আজীবন এক গর্বের বিষয়। আব্বাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিপাতে পৌঁছিয়ে সূর্যসেন হলের সামনে দিয়ে হেঁটে শাহবাগে অবস্থিত কোটা’য় যোগদান করতে গেলাম। শুরু হল সিভিল সার্ভিসে আমার জীবনের এক বৈচিত্রময় অধ্যায়ের।