বিশ্বাসের জায়গাটা ছোট হয়ে আসছে
এম এ মজিদ

বিশ্বের যে কোনো জায়গার যে কোনো সমস্যা আমাদেরকে কাঁদায়। গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড এ বিশ্বটা হাতের মুঠোয়। তাছাড়া প্রত্যেক দেশেই আমাদের আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীরা রয়েছেন। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে রয়েছে আমাদের দূতাবাস। ইতালীর কথা স্মরণ হলেই কিছু কিছু মুখ সামনে চলে আসে। বৃটেনকে তো আমাদের প্রতিবেশী মনে হয়। কত শত পরিচিত মুখ সেখানে। আমেরিকায় রয়েছে প্রিয় মানুষগুলো। একইভাবে আমাদের অনেক মানুষ বিভিন্নভাবে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নীড় গেড়েছেন ফ্রান্স স্পেন পর্তুগাল তুরস্ক ইত্যাদি দেশে। মধ্যপ্রাচ্যকে মনে হয় নিজেদের বাড়ি। সৌদী আরব গিয়ে হোটেল থেকে খাবার কিনে আনার আগেই দরজায় কড়া নড়তো, খাবারের টিফিন বক্স নিয়ে হাজির পরিচিত কেউ। এসব দেশে প্রবাসে থাকা মানুষগুলোকে বড় বেশি মিস করছি। তারা কেমন আছে, কি করছে, জানা হয়তো খুব সহজ এখন, তারপরও মন ভরে না, তৃপ্ত হতে পারি না। বিপরীতে বাংলাদেশ নিয়েও মৃত্যুর মুখোমুখি থাকা প্রবাসীরা কি পরিমাণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এক দু’জনের সাথে কথা বললে কিছুটা ধারণা করা যায়। প্রবাসীদের অনেকেই বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্য বিশ্বাস করতে নারাজ। তাদের দাবি-পৃথিবীর ইতিহাস বলে- করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের সংখ্যা প্রতিটি দেশে দিন দিন যেখানে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং তা এতোটাই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, আমেরিকা তাকে বুলেট ট্রেনের গতির সাথে তুলনা করেছে। ইতালী দুই হাত তুলে চোখের পানি ফেলে উপরওয়ালার সাহায্য চাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নাই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। চিনের সাথে আড়াই হাজার সীমান্তকে সীলগালা করে দিয়েছে। চিন তো করোনা আক্রান্ত ২০ হাজার রোগীকে গুলি করে মেরে ফেলার অনুমতি চেয়েছে কোর্টের কাছে। সেখানে আমাদের চিত্র ভিন্ন। আমাদের এক মন্ত্রী বলেছেন- আমেরিকা না কি করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাহায্য চায়। স্পেন থেকে বন্ধু হারুন ফোন করে জানতে চেয়েছে- বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা কি। স্পেন ক্রমাগতভাবে করোনা আক্রান্তে বিপর্যস্ত। পিছন দিক থেকে মৃত্যুদূত করোনা তাকে ধেয়ে আসছে, তারপরও দেশের মানুষের জন্য তার মায়া। আমেরিকার নয়নের সাথে তথ্য আদান প্রদান হয় প্রায়ই, সব সময় বলে, ভাই, বাংলাদেশের জন্য বড্ড চিন্তা হয়, না জানি কি হয়ে যায়, অথচ তার দরজায়ই করোনা নক করছে বেপরোয়াভাবে, দরজা খুললেই বিপদ, লন্ডনের মালেক ভাইর ঘুম হয়না, দেশে রেখে যাওয়া স্বজনদের চিন্তায়, অথচ লন্ডনে তার আশপাশের মানুষগুলোই করোনায় আক্রান্ত, কেউ মারা গেছেন, কেউ জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থানে। প্রত্যেকটি প্রবাসী মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে আমরা কেমন আছি। আমি সরকারের দেয়া তথ্যকে বিশ্বাস করতে চাই। বলি, ভাল আছি। তাদের মন ভরে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন- করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে আমরা কি খুশি হব? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আপনার চিকিৎসকগন যে বলছেন, করোনা আইডেন্টিফাই করার মতো পর্যাপ্ত পরীক্ষাই হচ্ছে না, তাহলে আমরা করোনা শনাক্ত করব কিভাবে। আমি আমার প্রবাসী আত্মীয়-বন্ধুদের শান্তনা দিয়ে বলি, আপনাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাই সর্দি কাশি করোনায় আপনাদের মৃত্যু হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলি, আপনারা পচাবাসি দুষিত খাবার খাননা, তাই আপনাদের পেটে অসুখের সাথে পরিচিতি নাই, পেটে অসুখের চিকিৎসা ব্যবস্থাও সেখানে অপ্রতুল। একইভাবে দুষিত ধুলাবালু আপনাদের নাক দিয়ে প্রবেশ করে না, কাজেই সর্দি কাশির সাথেও আপনাদের সম্পর্ক কম। পরের দিন কি খাবেন, সে টেনশন আপনাদের নেই, আনন্দ উল্লাস শেষে রাতে আপনাদের ঘুম হয় ভাল, টেনশন, কম ঘুম, এসবই হচ্ছে মাথা ব্যথার উপসর্গ। কাজেই আপনাদের মাথা ব্যথা হয় না, সেটা আপনাদের কাছে নতুন। জ্বরও আপনাদের কম হয়। বিপরীতে করোনার অন্যতম উপসর্গ হল, সর্দি কাশি, জ্বর, মাথা ব্যথা, পেটে অসুখ। এসব উপসর্গ আমাদের দেশে প্রত্যেকের প্রত্যেক দিনের শরীরের রুটিন। একাধারে এক সপ্তাহ এসব না হলে বরং আমরা টেনশনে পড়ে যাই, কোথাও কোনো ভুল হল কি না। যে পরিমান পচাবাসি দুষিত খাবার খেয়ে আমরা বেচে আছি, করোনা এসে আমাদের পেটের অসুখ বাড়িয়ে দিতে অক্ষম, প্রতিদিনের ধুলাবালির হজম শক্তির কাছে করোনা অসহায়, পরের দিনের খাবারের টেনশন আমাদের নিত্যসঙ্গী, রাতে ঘুম না হওয়া আমাদের রুটিন, কাজেই করোনার প্রভাবে মাথা ব্যথা হওয়ার মতো কোনো সুযোগই নাই। একই সাথে প্রবাসীদেরকে আমি স্মরণ করিয়ে দেই, আমাদের এক মন্ত্রী বলেছেন- করোনা হল, সর্দি কাশির চেয়ে একটু বেশি কিছু, এর চেয়ে বেশি না। তা হলে সেটা আমরা মানিয়ে নিতে পারব সহজেই। মুফতি ইব্রাহিম স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েও বলেছেন, করোনা না কি বলেছে-বাংলাদেশ তাদের টার্গেট না। সব মিলিয়ে আমরা ভালই আছি। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গাটা কেন ছোট হয়ে আসছে জানি না। ট্রাম্প বলেছেন-আমেরিকায় করোনা আক্রান্ত হয়ে এক লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ব্যাচারা আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা আরও ছোট করে দিল।

লেখকঃ আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ, ৩০ মার্চ ২০২০
০১৭১১-৭৮২২৩২