“একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার যে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি সেই রক্ত দিয়েই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, নিশ্চয়ই দুশমনরা বসে নাই, তারা চেষ্টা করছে বাংলার স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য। মনে রাখতে হবে আমার পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, তাদের কথা মনে রেখ যারা এই রাজারবাগে শহীদ হয়েছিল তোমাদেরই ভাই তারা, তারাও পুলিশের চাকরি করতো, জনগণের সাথে তারা হাত মিলিয়েছিল, ত্রিশ লক্ষ লোকের সঙ্গে অনেক পুলিশের লোকও আত্মত্যাগ করেছিল, তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। তাদের ইজ্জত তোমরা রেখ, তাদের সম্মান তোমরা রেখ, তাদের আত্মা যেন শান্তি পায় সেদিকে খেয়াল রেখ। মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। ইনশাআল্লাহ্ বাংলাদেশ টিকেছে, বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাদেশ থাকবার জন্য এই দুনিয়ায় এসেছে, এর পথ কেউ কোনোদিন বন্ধ করতে পারবে না। আজ আমরা জাতিসংঘের সদস্য, আজ আমার দুনিয়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ে, আজ আমার দুনিয়ার ম্যাপে বাংলাদেশের স্থান। একটা কথা ভুললে চলবে না তোমাদের, তোমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ। তোমরা ইংরেজদের পুলিশ নও। তোমরা পাকিস্তানি শোষকদের পুলিশ নও। তোমরা জনগণের পুলিশ, তোমাদের কর্তব্য জনগণকে সেবা করা, জনগণকে ভালবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা। তোমরাই একটা বাহিনী, যে বাহিনী বাংলার গ্রাম পর্যন্ত তোমরা রয়েছো। তোমাদের উপর বাংলার মানুষ চায় তারা শান্তিতে ঘুমাক, তোমাদের কাছ থেকে আশা করে যে চোর, বদমাইশ, গুন্ডা, দুর্নীতিবাজ কোন অত্যাচার না করে। তোমাদের কর্তব্য অনেক বেশি। আমি জানি তোমাদের নানা অসুবিধা আছে। প্রায় ৭০-৮০টা পুলিশের থানা তারা ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো নতুন করে আমরা গড়তে চেষ্টা করতেছি। অনেকগুলো করা হয়েছে, অনেকগুলো হচ্ছে। তোমাদের কিছুই ছিল না। আজ আস্তে আস্তে তোমাদের কিছু কিছু হতে চলেছে। একদিনে কিছুই হবে না। বাংলার মানুষ দুঃখী, বাংলার মানুষ গরীব, বাংলার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়। যুগ যুগ ধরে তারা শোষিত হয়েছে। তারা আজকে যে অবস্থায় তোমরা ভাল করেই জানো, তোমরা বিদেশ থেকে আসো নাই, তোমরা ভাড়াটিয়া নও। তোমরা বাংলা মায়ের ছেলে, তোমার বাপ-মা এই বাংলাদেশে রয়েছে, তাদের অবস্থা তোমরা জানো আমি তোমাদের উপর নিশ্চয়ই এই আশা করবো যে আমি যেন তোমাদের জন্য গর্ব অনুভব করতে পারি।”
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে তঁাঁর স্বপ্ন ও ভাবনার এই কথাগুলো ব্যক্ত করেছিলেন ১৯৭৫ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহের প্রদত্ত ভাষণে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্নের সোনার বাংলায় পুলিশকে জনগণের পুলিশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। “মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার” এ স্লোগানের দৃপ্ত শপথে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য কমিউনিটি পুলিশিং এর পাশাপাশি সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে হবিগঞ্জ জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন বিট অফিসার রয়েছে। বিট অফিসার, অফিসার ইনচার্জ এবং সার্কেল অফিসার মিলে ২০১৯ সালে ১২১৯টি এবং ২০২০ সালের ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ১৮০টি বিরোধ নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশীয় অস্ত্র জমাদান, জনসচেতনতামূলক স্লোগান সংবলিত লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচির ফলে দাঙ্গাপ্রবণ হবিগঞ্জবাসী এখন “ফিকল ছেড়ে কলম ধরি, দাঙ্গামুক্ত হবিগঞ্জ গড়ি” এই স্লোগানে বিশ^াসী। এছাড়াও প্রতিদিন বিভিন্ন অভিযোগ দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সার্কেল অফিসারের কার্যালয় ও থানায় আগত জনগণকে আইনি পরামর্শ ও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বিট পুুলিশিং এর আওতায় বিরোধ নিষ্পত্তিসহ এসব কার্যক্রমে বিগত বছরে সাড়ে ছয়শত মামলা কমেছে।
হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের ডিএসবি শাখা থেকে দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকায় পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- জনগণের পুলিশ হয়ে ওঠার জন্য হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে-
শুধু গতানুগতিক পুলিশিংই নয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ কর্তৃক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় মাদকাসক্তি, দাঙ্গা, জঙ্গিবাদ, ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ বিরোধী রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এই পর্যন্ত ৫০০ টিরও বেশি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় রচনা প্রতিযোগিতা শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক শ্লোগান লিখিত খাতা ও শিক্ষার উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা তৈরির জন্য ৭টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে- নেশা, বলি, পরিণাম, পরিণতি, উত্যক্ত, দ্যা মিশন ও আসক্তি। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও জনসমাবেশে এই চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে জনসচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও আদর্শ সন্তান গড়ে তোলার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী ও মা সমাবেশ এর আয়োজন করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, পুলিশের দায়িত্ব দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা। হবিগঞ্জে জেলা পুলিশ যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই বছর হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দশ হাজারেরও বেশি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। শীতবস্ত্র বিতরণকালে চা বাগান গুলোতে মাদক বিরোধী সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে প্রয়োজনীয় আইনি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিটি থানায় এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নারী ও শিশু বিষয়ক হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। যার দায়িত্বে রয়েছেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা।
প্রান্তিক জনগণের কাছে ছোট ছোট লিফলেট এর মাধ্যমে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বর বিতরণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণ যে কোন সমস্যায় অফিসার ইনচার্জ, সার্কেল অফিসার এবং পুলিশ সুপারের সাহায্য লাভ করতে পারে। ব্যতিক্রমধর্মী পুলিশি সেবা প্রদান করে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ জনগণের অন্তরে স্থান নেয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের এই চেষ্টা কতটুকু সার্থক তা মূল্যায়ন ও পরামর্শ প্রদানের দায়িত্বটুকু হবিগঞ্জের আপামর জনসাধারণ ও সুশীল সমাজের ওপর ছেড়ে দেয়া হলো। আশা করি আপনাদের মূল্যায়ন ও মূল্যবান পরামর্শ ভবিষ্যতে জনবান্ধব পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।