স্টাফ রিপোর্টার ॥ হাসপাতালের বেডে শুয়ে স্বজনদের কাছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজেই বলছিলেন, বাবু তো নেই আমি জানি। জান্নাতও মারা যাবে, আমিও হয়তো বাঁচবো না। আমার জন্য দোয়া করো। এমন কথার একদিন পরেই গতকাল সকালে অগ্নিদগ্ধ শহীদুল কিরমানি রনি চলে গেলেন স্ত্রী সন্তানদের কাছে, না ফেরার দেশে। দিলু রোডের বাসায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে রনির শিশু সন্তান ঘটনার দিনই মারা যায়। রোববার মৃত্যু হয় তার স্ত্রী জান্নাতের। পুরো পরিবারটি অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছিল একটি রঙিন ছবি। সন্তানের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর ওই ছবিটি এখন কেবলই স্মৃতি।
বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকার ইস্কাটনের দিলু রোডের পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় আগুন লেগে মারা যান একই পরিবারের তিনজনসহ আরো দুইজন। ঘটনার দিন ভবনে আগুন লাগার বিষয়টি টের পেয়ে শিশু সন্তান এ কে এম রুশদীকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামছিলেন বাবা-মা। এসময় বাবার হাত ফসকে বেরিয়ে যায় রুশদী। আগুন ধোঁয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে আর টিকতে পারেনি শিশু রুশদী। বৃহস্পতিবার ভোরে ইস্কাটনের দিলু রোডের পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার সিঁড়িতে শিশুটির পোড়া দেহ পড়েছিল। অগ্নিদগ্ধ শহিদুল কিরমানী, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল ভোরে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন, হাসপাতালের সমন্বয়কারী ড. সামন্ত লাল সেন। শহিদুলকে নিয়ে অগ্নিকান্ডের ওই ঘটনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচজনে। ঘটনার দিন নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের একটি পাঁচতলা ভবনের গ্যারেজে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সেদিনই মারা যায় শিশু রুশদিসহ তিনজন। আর আগুনে দগ্ধ হন শহিদুল কিরমানী ও তার স্ত্রী জান্নাতুল। এর মধ্যে শহিদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ ও তার স্ত্রী জান্নাতুলের ৯৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টি সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যান জান্নাতুল। আর তার স্বামী শহিদুল কিরমানীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে রোববার সকালে নেয়া হয় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান শহিদুলও। শহিদুলের বাবা একেএম শহীদুল্লাহ বলেন, তার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে শহিদুল বড়। দিলু রোডের ওই বাসার তিন তলায় থাকতেন পরিবার নিয়ে। তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদি জেলার শিবপুর উপজেলায়। বিআইভিপি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। পাশাপাশি আইসিএমএ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাষক হিসেবেও কাজ করতেন। তার স্ত্রী জান্নাত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এ হিসাবরক্ষক ছিলেন। শহীদুল কিরমানির মামাতো বোন শেখ রেশমী বলেন, পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে গেল। এই ঘা শুকানোর মতো না। আজীবন এই ঘা আমাদের বয়ে চলতে হবে। তিনি বলেন, ভাইয়া (শহীদুল কিরমানি) জানতেন তার শিশু সন্তান রুশদি মারা গেছে। তার স্ত্রীও নেই। তিনিও মারা যাবেন। ভাবি (জান্নাতুল ফেরদৌসী) যখন মারা যান তখন ভাইয়া লাইফ সাপোর্টে। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর না জানলেও ঘটনার পরপরই হাসপাতালে শুয়ে আঁচ করতে পেরেছিলেন রুশদি আর নেই। ভাইয়া হাসপাতালে নিজেই বলছিলেন- আমার কলিজার টুকরা রুশদি তো নেই আমি জানি। তোমার ভাবিও মারা যাবে, আমিও হয়তো বাঁচবো না। ভাইয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে, একে একে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ‘এই কষ্ট সহ্য করার মতো না। পুরো পরিবার শেষ গেলো, এই ঘা কখনই শুকাবে না।’ বড় বোন নাসরিন বলেন, স্ত্রী জান্নাত ও ছেলে রুশদির কবরের পাশেই গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ইটনা গ্রামে শহীদুল কারমানির মরদেহ গতকাল বাদ আছর দাফন করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদায় দিয়ে আসলাম। ভাইয়ের হাসিমাখা মুখ আর দেখতে পারবো না। যে স্মৃতি ভাই দিয়ে গেলেন, জীবনভর সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াবো। সূত্র: মানবজমিন
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com