পাহাড়ি টিলায় অবস্থিত মধুপুর চা বাগানটি বেশ নয়নাভিরাম
বোরো মৌসুমে দেশের নানা স্থানে সারের সংকট ও নানারকম কিস্সা-কাহিনীর উদ্ভব হলেও হবিগঞ্জে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি
আতাউর রহমান কানন
৪ মে ২০০৮, রবিবার। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে। আজ সকাল ১০টায় হবিগঞ্জের সদর গোডাউনে গিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ১.৫ টন ধান সরকার ঘোষিত প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে ক্রয় করি। কিছু ধানের বস্তা এক জায়গায় স্তূপীকৃত দেখলাম। সেগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান যে, ওই ধানের ময়েশ্চার ১৫% এর বেশি হওয়ায় আপাতত নেওয়া যাচ্ছে না। ওগুলো এখন আটক আছে। গোডাউনের চাতালে শুকিয়ে ময়েশ্চার নির্ধারিত মাত্রার ভেতরে এলে ক্রয়ের জন্য বিবেচ্য হবে। আর এটাই ক্রয়ের নিয়ম।
এরপর সেখান থেকে মাধবপুর উপজেলায় গিয়ে ইমামদের সম্মেলনে ‘ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক অবহিতকরণ’ সভায় যোগদান করি। সভায় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বক্তরা বক্তব্য রাখেন। সরকারের এধরনের অবহিতকরণ সভার উদ্দেশ্য একটাই দেশের মানুষ তাদের আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে নিজ পরিবারটাকে আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তুলুক। আর এক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতা বা ইমামগণ সোচ্চার হলে মানুষ ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে আসবে। আমি দেড়টায় মাধবপুর থেকে নিজ অফিসে ফিরে আসি। অফিসে ডাক ফাইলে দেখি নতুন কমিশনার ড. জাফর আহমদ খান আগামীকাল হবিগঞ্জে সফরসূচি দিয়েছেন। তাঁকে অবশ্য আমি সৌজন্য সাক্ষাতের দিন দাওয়াত করে এসেছিলাম। আমি আমার কর্মকর্তাদের ডেকে কমিশনারের সফরসূচি অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলাম।
পরের দিন সকাল ১০টায় বিভাগীয় কমিশনার ড. জাফর আহমদ খানকে সার্কিট হাউজে সালামির মাধ্যমে যথাযথভাবে রিসিভ করি। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সুধীবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি যোগদান করেন। দুপুরে তাঁর সম্মানে জেলা প্রশাসনের প্রদত্ত মধ্যাহ্নভোজে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সফরসূচি অনুযায়ী বিকেল ৩টায় তাঁকে বাহুবল উপজেলায় নিয়ে যাই। তিনি উপজেলা কার্যালয় পরিদর্শন করেন। অতঃপর ইউএনও বাহুবল কর্তৃক আয়োজিত উপজেলার কর্মকর্তা ও সুধীজনদের সাথে সৌজন্য মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সেখান থেকে তিনি সিলেট ফিরে গেলে আমি হবিগঞ্জ সদরে ফিরে আসি।
৮ মে ২০০৮, বৃহস্পতিবার। সরকার কৃষকদের ডিজেল ভর্তুকি দেওয়ার বরাদ্দ প্রদান করেছে। সে মতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ তালিকাভুক্ত কৃষকদের নীতিমালার আলোকে চেকের মাধ্যমে ডিজেল ভর্তুকির টাকা বিতরণ করছে। আমাকে উপজেলাসমূহে নিয়ে এই চেক বিতরণের কাজ উদ্বোধন করানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সকালে বানিয়াচং উপজেলায় গিয়ে চেক বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করি।
বানিয়াচং থেকে নিজ অফিসে ফিরে বিকেল ৩টায় হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কমিটির সভা করি। ঈদগাহটির সংস্কার কাজ চলছে। আজকের সভায় সে কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়।
আজ সন্ধে ৬টায় বিশ্ব রেডক্রিসেন্ট দিবস উপলক্ষ্যে হবিগঞ্জ রেডক্রিসেন্ট কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি। এ দিবস উপলক্ষ্যে শিশু-কিশোরদের মধ্যে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি। সেখান থেকে ৭টায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে সংস্থার নির্বাহী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। সভা চলাকালীন হবিগঞ্জের ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। সেই সাথে মুষলধারায় বৃষ্টি নামে। সে বৃষ্টিধারায় বিগত কয়েক দিনের গুমোট আবহাওয়া শীতল হয়ে যায়। সভাশেষে ঝড় থামলে রাত ৯টায় বাসায় ফিরে আসি।
১৩ মে ২০০৮, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সাড়ে ১২টায় আলোর সন্ধানে শিক্ষা ফাউন্ডেশনের কার্যকরী কমিটির সভা করি। এ সভায় ফাউন্ডেশনের ফান্ড বৃদ্ধির তৎপরতা ও অনুদান প্রদানের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জের স্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক বিবিয়ানা’র ডিক্লারেশন স্বাক্ষর করি। অতঃপর ৫টায় রিচি গ্রামে গিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা কাশেম আলী পাঠাগার’-এর উদ্বোধন করি। বক্তব্য ছাড়া অনুষ্ঠান নাই। সে রেওয়াজে এখানেও বক্তব্যের পালা চলে। উপস্থিত অতিথিদের অনেকেরই বক্তব্য শুনি। আমি নিজেও বক্তব্য রাখি। গ্রামের ভেতর জ্ঞানের সাগর বলে অভিহিত পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে, বীরমুক্তিযোদ্ধা কাশেম আলী স্বয়ং জবাব দিলেন- ‘এই পাঠাগারে পাঠক এসে পড়াশোনা করবে, জ্ঞান অর্জন করবে। আমি একদিন থাকব না, পাঠক থাকবেন; আর আমি তাদের মধ্যে বেঁচে থাকব।
তাঁর কথাগুলো আমার ভাবনায় ঢেউ তুলে। আমি কিছুক্ষণ তাঁর দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকি। শিক্ষাজগতে এমন মহৎ কাজ কজনই বা করতে পারেন। অনুষ্ঠান শেষে আমি কিছু অনুদান ঘোষণা করে সন্ধ্যালগনে বাসায় ফিরে আসি।
১৬ মে ২০০৮, শুক্রবার। আজ সাপ্তাহিক দিনটি বাসাতেই নিজের মতো করে কাটাই। কদিন আগে দেশের বাড়ি থেকে প্রথমে বড় ভাই আলহাজ মো. আবদুল হালিম, এবং তার দুদিন পর সেজো ভাই মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মো. আবুবকর সিদ্দিক বেড়াতে আসেন। আজ দুজনই একসাথে সকাল ৯টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। আমার পদগত নানা ব্যস্ততা সত্ত্বে সহোদর ভাইদের সাথে কয়েকটা দিন বেশ আনন্দেই কাটে।
১৭ মে ২০০৮, শনিবার। আজ সপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিন। গত রাতে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন সার্কিট হাউজে এসে উঠেছেন। আজ সকাল ১০টায় তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। জেলা জজ ও তাঁর অফিসারগণ মাননীয় বিচারপতির দেখভালে রয়েছেন। সেখান থেকে পৌর লাইব্রেরিতে যাই। লাইব্রেরি হলে হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় যোগদান করি। সুশীল সাহিত্যচর্চা ও রচনার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আজকের সভায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সেখান থেকেই ১২টায় আমি সিলেটের উদ্দেশে রওনা করি। সিলেট ডিসি অফিসের সম্মেলনকক্ষে ২টা থেকে প্রাক-বাজেট মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠান হয়। এ অনুষ্ঠানে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জা আজিজুল হক প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। মতবিনিময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে।
সিলেট থেকে সাড়ে ৬টায় হবিগঞ্জ ফিরে এসে রাত ৮টায় টেনিস খেলতে যাই। রাতের আকাশ ভালো থাকলে, আর আমি অন্যকোনো কাজে আটকা না থাকলে, এ খেলায় আমার কোনো মিস নেই বললেই চলে।
২১ মে বুধবার, ২০০৮। আজ সকাল থেকেই পর পর কয়েকটি সভা-সেমিনারে ব্যস্ত থাকি। তন্মধ্যে সকাল ১০টায় সিভিল সার্জন কার্যালয়ে আয়োজিত অওউঝ/ঐওঠ সংক্রান্ত সেমিনারে যোগদান করি। সেখান থেকে অফিসে ফিরে সাড়ে ১১টায় জেলা জালনোট প্রচলন প্রতিরোধ কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। জালনোট চিহ্নিত করার উপায়, হবিগঞ্জে এর বিস্তৃতি ও এর প্রস্তুতকারী-বহনকারীর শাস্তিবিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পায়। এ সভার পরপরই জেলা সার মনিটরিং কমিটির সভা করি। বর্তমানে জেলায় কোনো সারের সংকট নেই বলে হবিগঞ্জ সার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. মোতাব্বির হোসেন জানান। বিগত বোরো মৌসুমে দেশের নানা স্থানে সারের সংকট ও নানারকম কিস্সা-কাহিনীর উদ্ভব হলেও হবিগঞ্জে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ জন্য সার ব্যবসায়ী সমিতিকে সভায় বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেওয়া হয়।
আজ আমাদের কন্যা লিসার জন্মদিন। এ উপলক্ষ্যে গতকাল সন্ধ্যায় আমার স্ত্রী কন্যাসহ ঢাকা থেকে এসেছে। সাথে এসেছেন কন্যার নানা-নানি।
জন্মদিন বলে কথা! কেকের অর্ডার দেওয়া ছিল। রাতে ঘটা করেই কেক কাটা হয়। পরিবারের মধ্যে আর অনুষ্ঠানটি সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমার অফিসের কর্মকর্তাদের সপরিবারে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
পরের দিন শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার সচিব কাজী আমিনুল ইসলাম হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে বেড়াতে আসেন। আমি সেখানে যাই। জুমার নামাজ ও লাঞ্চ সেখানেই হয়। তিনি চলে গেলে বিকেল ৪টায় আমি বাসায় ফিরে আসি। সাড়ে ৪টায় আমার শ্বশুড়-শাশুড়ি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন। তাঁদের ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও নাতনির জন্মদিন পালনের আবদার রক্ষার্থেই এবার স্বল্প সময়ের জন্য হবিগঞ্জ এসেছিলেন।
২৬ মে ২০০৮, সোমবার। এরমধ্যে এক বিকেলে বাহুবলের অন্তর্গত মধুপুর চা বাগানের ম্যানেজার শামীম খান ভাবিসহ আমার বাসায় বেড়াতে এসে আমাদেরও তাঁর বাগানে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে যান। আজ সাড়ে ১২টায় স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে তাঁর সেই দাওয়াত রক্ষার্থে যাই। শামীম খান আমার পূর্বপরিচিত। আমি একসময় যখন হবিগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম, তখন থেকেই আমাদের পরিচয় এবং পারিবারিকভাবে আসা-যাওয়া ছিল। সেও দেখতে দেখতে প্রায় ১৬ বছর অতিক্রান্ত। সে সময় তিনি আমার বাসার ড্রয়িংরুমের জন্য দুটি চা গাছের শোভাবর্ধক টেবিল তৈরি করে দিয়েছিলেন। সে টেবিল দুটো এখনো আমার ঢাকার বাসার ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধন করে যাচ্ছে। পাহাড়ি টিলায় অবস্থিত বাগানটি বেশ নয়নাভিরাম! গাড়িতে করে আজও বাগানটি ঘুরেফিরে দেখি।
আজ মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে আকাশে মেঘ-রোদের খেলা থাকায় আবহাওয়াটা তেমন অসহ্য ছিল না। বাগানের রান্নাবান্নার এমনিতেই সুনাম আছে। তদুপরি শামীম খানের অকৃত্রিম অতিথি পরায়ণতায় আমাদের জন্য আয়োজন ছিল ব্যাপক। আমরা আমাদের সাধ্যমত খেলাম। ফেরার সময় ঘনিয়ে এলে বিদায় নিয়ে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি।
৩০ মে ২০০৮, শুক্রবার। হবিগঞ্জের বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মিয়াজ উদ্দিনের বাড়ি আমাদের এলাকায় সাভারের নয়ারহাট বাজার সংলগ্ন চাকলগ্রাম গ্রামে। আমার বাড়ি ধামরাই হলেও দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। তিনি একজন মিষ্টভাষী সাহিত্যমনা মানুষ। আমি তাঁকে আগে চিনতাম না। এ জেলায় তিনি আসার পরই দুজনের পরিচয় হয়। আজ তাঁর বাসায় আমাদের সপরিবারে দাওয়াত। জুমার নামাজের পর জজ সাহেবের বাসা যাই। অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে আপ্যায়িত হয়ে বিকেল ৪টায় নিজ বাসায় ফিরে আসি। (চলবে…)