চালের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকার ওএমএস চালু করে
হবিগঞ্জের অন্যতম কৃতী সন্তান এমএ কবির এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘কবির কলেজিয়েট একাডেমি’ উদ্বোধন করি
আতাউর রহমান কানন
২১ মার্চ ২০০৮, শুক্রবার। আজ বেলা ১টায় ঢাকা থেকে আমার সহধর্মিণী কন্যাসহ হবিগঞ্জ আসে। ওরা এবার দিন দশেক আমার সাথে অবস্থান করবে। সামনে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসকে উপলক্ষ্য করেই এবারের আসা। ওদের বাসায় রেখে আমি আমার অফিসের সিনিয়র অফিসারসহ স্থানীয় বিশিষ্ট সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুল মোতালিব চৌধুরীর মেয়ের বিয়েতে যোগদান করি।
স্থানীয় সুধীজন তাঁদের এরূপ অনেক অনুষ্ঠানেই আমাকে আমন্ত্রণ করেন কিন্তু সব আমন্ত্রণই চাকরিগত কারণে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। আজকের আমন্ত্রণ বাছাই করা আমন্ত্রণগুলোর অন্যতম।
২২ মার্চ ২০০৮, শনিবার। হবিগঞ্জ শহরের দক্ষিণপ্রান্তে আনন্দপুর এলাকায় হবিগঞ্জের অন্যতম কৃতী সন্তান এমএ কবির ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘কবির কলেজিয়েট একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজ সকাল ১১টায় আমি সেই একাডেমির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করি। সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট চৌধুরী আবদুল হাইয়ের সভাপতিত্বে অন্যান্য অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানের শেষপর্বে হবিগঞ্জের সুরবিতান ললিতকলা একাডেমি কর্তৃক এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।
২৪ মার্চ ২০০৮, সোমবার। সকাল ৯টায় বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত র‌্যালিতে যোগদান করি। সেখান থেকে সাড়ে ৯টায় বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করি। হবিগঞ্জের এই স্কুলটি ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার সহযোগিতায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। স্কুলটি এরমধ্যেই এলাকায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
দুপুরের কিছুটা আগে আমার অফিসে প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি হারুনুর রশিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সাংবাদিক মোহাম্মদ নাহিজ, চৌধুরী মো. ফরিয়াদ, ফজলুর রহমানসহ কয়েকজন সাক্ষাতে আসেন। কুশল বিনিময়ের পর সাংবাদিক নেতা হারুনুর রশিদ চৌধুরী বললেন- স্যার, আপনার ওপর আশাভরসা করে একটি দাবি নিয়ে এসেছি। আপনি সদয় হলে আমাদের আশাটি পূরণ হবে।
আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম- আশাভরসাটা কেমন?
-স্যার, আমরা সাংবাদিকগণ আমাদের জন্য একটি আবাসিক এলাকা গড়ার জন্য অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি কিন্তু জুতসই জমির জন্য পারছি না। আপনি সহায় হলে এবার সম্ভব হবে।
-তেমন কোনো জায়গার সন্ধান কি আপনারা পেয়েছেন?
-জি স্যার। চৌধুরীবাজারের নামায়, বেইলি ব্রিজের ঠিক পশ্চিমে খোয়াই নদীর তীরে।
-জায়গাটির বর্তমান অবস্থা কী?
-কিছু অবৈধ দখলদার আছে, আর বাকি অংশ ময়লা-আবর্জনায় ভরা।
-আপনাদের পছন্দ হলে আবেদন করতে পারেন। তবে সময় লাগবে। বন্দোবস্ত প্রস্তাবের নথি প্রস্তুত করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। সেখানে অনুমোদন হলেই আপনারা পাবেন।
-তাতে অসুবিধা নাই।
-ঠিক আছে, আপনাদের নামের তালিকাসহ পৃথক পৃথক আবেদনপত্র দাখিল করুন। আমার অফিস থেকে বাকি কাজ করা হবে।
তাঁরা আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে একরকম সন্তুষ্টি নিয়ে চলে যান। হবিগঞ্জের সাংবাদিকদের আমি এ জেলায় পূর্ব-চাকরিসূত্রে চিনি। তাঁদেরকে সব সময়ই প্রো-অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ মনে হয়েছে। আমি তাঁদের পূর্ব-পরিচিতজন ডিসি হিসেবে এ জেলায় আসাতে তাঁদের এরকম আশাভরসা থাকতেই পারে। আইনগতভাবে কোনো অসুবিধা না থাকলে তাঁদের আশা পূরণ করতে আমার প্রচেষ্টা থাকবে।
বিকেল সাড়ে ৪টায় হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়ামে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের ফাইনাল খেলার পুরস্কার বিতরণ করি। এবারের প্রতিযোগিতায় মালঞ্চ ক্রিকেট ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয় এবং রানার্স আপ হয় শাপলা সংসদ।
২৬ মার্চ ২০০৮, বুধবার। আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অনুরূপ হবিগঞ্জ জেলায়ও দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এদিন ভোর ৫:৫৫ মিনিটে তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা করা হয়। এরপর ৬টায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক প্রদান করার পর বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থা-সংগঠন সুশৃঙ্খলভাবে পুষ্পস্তবক প্রদান করে।
আমি সকাল আটটায় হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়ামে জাতীয় সংগীতের তালে তালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। এরপর মার্চপাস্টের জন্য মাঠে সারে সারে দাঁড়ানো পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, বিএনসিসি, মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি দেখানোর জন্য প্যারেড কমান্ডার অনুরোধ জানালে, পুলিশ সুপারসহ সুসজ্জিত বাদক দলের বাদ্যের তালে তালে সে সমাবেশ পরিদর্শন করে সালামি গ্রহণ মঞ্চে এসে দাঁড়াই। এবার প্যারেড কমান্ডার মার্চপাস্টের অনুমতি নিয়ে বাদ্যের তালে তালে সকল অংশগ্রহণকারী দল নিয়ে একে একে কুচকাওয়াজ করে সালামি মঞ্চ অতিক্রম করে যেতে থাকেন। প্রতিটি দলের দলপতি মঞ্চ অতিক্রমের সময় দক্ষতার সাথে স্যালুট দিতে থাকেন। আমি পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে যথারীতিতে তাঁদের সালামি গ্রহণ করি।
স্টেডিয়াম উপচেপড়া দর্শকবৃন্দ আজকের রোদ-মেঘের খেলায় আরামদায়ক সকালের আবহাওয়ায় অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। মার্চপাস্ট শেষে প্রথা অনুযায়ী হবিগঞ্জবাসীর উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসকের সংক্ষিপ্ত বাণীতে মহান স্বাধীনতার তাৎপর্য তুলে ধরে সকলের সুখসমৃদ্ধি কামনা করি।
এরপর শিক্ষার্থীদের দলে দলে নানারকম মনোমুগ্ধকর শারীরিক কসরত শুরু হলে আমি পুলিশ সুপারসহ প্যান্ডেলে গিয়ে অবস্থান নিই। প্যান্ডেলে আগে থেকেই জেলারপদস্থ কর্মকর্তা ও আমন্ত্রিত সুধীজন উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন। অতিথি-দর্শকবৃন্দ অত্যন্ত আনন্দচিত্তে শারীরিক কসরত উপভোগ করেন। এরপর বিচারকদের স্থাননির্ধারণি রায় অনুযায়ী অংশগ্রহণকারীদের পুরস্কৃত করা হয়।
অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় সকাল ১১টায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কালেক্টরেট ভবন প্রাঙ্গণের নিমতলায় নির্মিত প্যান্ডেলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তাঁদের উপহার সামগ্রী প্রদান ও আপ্যায়িত করা হয়। বিকেলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পরিচালনায় জালাল স্টেডিয়ামে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ এবং রাতে নিমতলায় আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটির উদ্যাপন শেষ হয়।
পাশাপাশি হবিগঞ্জ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ মাঠে জেলার মহিলাদের নিয়ে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসকের স্ত্রী পদাধিকার বলে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি হওয়ায় তিনি তাঁর সংস্থার সদস্যদের নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। আর জেলা প্রশাসক হিসেবে আমাকে সেখানে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করায় আমি সেখানে পুলিশ সুপারকে সাথে নিয়ে যথাসময়ে হাজির হই এবং পুরস্কার বিতরণ করি।
৩১ মার্চ ২০০৮, সোমবার। সকালে যথারীতি অফিসে যাই। ১১টায় জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি। এ উপলক্ষ্যে আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নির্মাণ করি নিরাপদ বাড়ি, ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করি’ নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দপ্তরের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ ও সাংবাদিক-সুধীজন এ সভায় অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁদের অনেকেই বক্তব্য রাখেন। ভূমিকম্প মোকাবেলা ও আসন্ন গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের যেকোনো দুর্যোগের অবস্থা বিবেচনা করে জেলা-উপজেলায় আগাম প্রস্তুতি ও ত্রাণ সহায়তার সক্ষমতা নির্ধারণ করে রাখাই এই দিবসটি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
বিকেল ৩টায় হবিগঞ্জ দারুচ্ছুন্নাৎ কামিল মাদরাসার গভর্নিং বডির সভা করি। আমি অনেক মাদরাসারই কমিটির সভাপতি। তুলনামূলকভাবে এই মাদরাসার কাজকর্ম বেশ স্বচ্ছ বলে আমার কাছে মনে হয়।
সন্ধে ৭টায় সরকারি জরুরি নির্দেশনা প্রাপ্ত হয়ে জেলা ওএমএস (খোলা বাজারে চাল বিক্রি) কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। দেশে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৫-৩৬ টাকা এবং সরু চাল ৪৫-৫০ টাকায় উঠাতে সরকার বেশ বিব্রত অবস্থায় আছে। চালের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকার এখন ওএমএস কর্মসূচি চালু করে কম দামে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ বিকেলেই এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশ পেয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আমিনুল এহসান একরকম দৌড়ে এসেছেন। তাই আমিও জরুরিভাবে জেলা ওএমএস কমিটির সভা ডেকে জরুরিভিত্তিতে ডিলার নিয়োগ ও বিক্রয় কেন্দ্র নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিই। (চলবে…)