স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে জমকালো আয়োজনে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পুনর্মিলনী উদযাপন করা হয়। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হবিগঞ্জে এসে পৌঁছান। গত কয়েক মাস ধরে আয়োজক কমিটি হবিগঞ্জ-সিলেট-ঢাকায় অবস্থানরত প্রাক্তন ছাত্রদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা-পরিকল্পনা ও সভা করে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। গতকাল শনিবার ছিল নির্ধারিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সকাল থেকে দুই হাজারেরও অধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির। বিশেষ অতিথি ছিলেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক দেবী চন্দ, পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলি, স্কুলের প্রধান শিক্ষক শেখ আলফাজ উদ্দিন। এ ছাড়াও বিদ্যালয়ের প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। শনিবার রাত প্রায় একটায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
গত প্রায় ১০ দিন ধরে হাজার হাজার রঙিন বাতির আলোয় আলোকিত ছিল স্কুল ক্যাম্পাসসহ আশপাশের রাস্তা। প্রতিদিনই সাজ সজ্জায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। স্কুলের ভেতরের রাস্তায় আঁকা হয়েছে আলপনা। প্রয়াত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পোর্ট্রেট টানানো হয়েছে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে চলাচলের রাস্তার উভয় পাশে। আর এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিদিন বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ভিড় করেছেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ। আর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সতীর্থদের কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। আনন্দ আড্ডা আর গানে মেতে ওঠেন। ফাঁকে ফাঁকে অতীত স্মৃতি রোমনস্থ করেন। সকালে র্যালীর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়।
পুনর্মিলনী কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মনজুর উদ্দিন আহমদ শাহিন বলেন, শনিবার সকাল ৮টায় বর্ণাঢ্য র্যালীর মাধ্যমে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে শুভ সূচনা হয়। সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। রাতে জালাল স্টেডিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করে দেশের বিখ্যাত ব্যান্ডদল সোলস্, এমএনবি ও পিন্টু ঘোষ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়াম ছিল দর্শক-শ্রোতায় কানায় কানায় পুরপূর্ণ।
১৮৮৩ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জন্ম হয়েছিল তৎকালীন মহকুমা সদর লস্করপুর এলাকায়। পরবর্তীতে এটিকে হবিগঞ্জ স্থানান্তর করা হয়। এর চালিকাশক্তি ছিল জনসাধারণের চাঁদা, অনুদান আর শিক্ষার্থীদের বেতন। সে সময় এনট্রান্স পরীক্ষায় ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল ফলাফলের স্বীকৃতি স্বরূপ মাসিক ১০০ টাকা হারে সরকারি অনুদান পাওয়া যেত। অসংখ্য আলোকিত মানুষ তৈরির ‘ফ্যাক্টরি’ বলে খ্যাত এই বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন রসিক লাল সেন এম, এ। বর্তমানে যে সুরম্য ভবনগুলো দেখা যায় তা খুব সহজে তৈরি হয়নি। ওই সময়ে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান ও ফলাফলের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন আসামের চিফ কমিশনার ১৯০৪ সালে ভবন নির্মাণের জন্য ১০ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন। এর সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয়দের অনুদান ও বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে নিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯০৭ সালে। পুরনো ঘরগুলো হিন্দু হোস্টেলে রূপ নেয়। সে সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। পরবর্তী সময়ে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৯২০ সালে ২০ হাজার টাকায় মুসলিম ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়। ১৯১১ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায় বিদ্যালয়টি। ওই বছরে কুঞ্জবিহারী গুহঠাকুরতা এমএ হবিগঞ্জ সরকারি ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়ে যোগদান করেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে সরকারি মঞ্জুরি পায়। তিনি ১১ বছর অর্থাৎ ১৯২২ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের পদে ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ১৮৮৩-১৮৯৫ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. দিনেশ চন্দ্র সেন এবং উপমহাদেশের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাগ্মীনেতা হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামের কৃতি সন্তান বিপিন চন্দ্র পাল এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯০৪ সালে সরকারি অর্থে নির্মিত বিদ্যালয়ের দুটি প্রধান ভবন ১৯২২ সালে কে বা কারা পুড়িয়ে দেয়। তখন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ৫৫ জন অংশ নেন। পাস করেন শতভাগ। এর মধ্যে ৪৫ জন ১ম বিভাগে, ২য় বিভাগে ৯ জন, ৩য় বিভাগে ১ জন। শুধু তাই নয় : ৫ জন (মোট ১ হাজার মার্কের মধ্যে ৭৫০) স্টারমার্ক, লেটার আসে (প্রতি বিষয়ে ১০০ মধ্যে ৮০ মার্ক) ৪৬টি। ছাত্রদের ভালো ফলাফল অন্যদিকে বিদ্যালয় ভবনের করুন দশা তৎকালীন সরকারের দৃষ্টিতে পড়ে। ১৯২৫-২৬ ও ১৯২৬-২৭ অর্থবছরে সরকার ৮১ হাজার টাকা ভবন নির্মাণে মঞ্জুর করেন। সেই অর্থে আসাম প্যাটার্নে নির্মিত চারটি লাল ভবন সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০-৬১ সালে ল্যাবরেটরি ভবন, মিলনায়তন, মসজিদ, ব্যায়ামাগার, আর্ট অ্যান্ড ক্রেফট রুম নির্মাণে ৯৩ হাজার ৫৩১ টাকা ব্যয় হয়।
বুয়েটের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম এ রশিদ, সাবেক বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার চৌধুরী এটিএম মাসুদ, কথাসাহিত্যিক মিরজা আব্দুল হাই, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আব্দুল খালেক, শিক্ষাবিদ এম বি চৌধুরী, সাংবাদিক ও গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান, কথাসাহিত্যিক মিরজা কবি দেওয়ান মোর্তাজা, কবি শামসুদ্দিন আহমেদসহ শত শত কৃতী এই স্কুলে লেখাপড়া করেছেন।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com