প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় আসামী জাকির মেয়েটিকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণের চেষ্টা চালায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চলন্ত সিএনজি অটোরিকশা থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। মেয়ের খুনের রায় দেখে যেতে পারেনটি জেরিনের বাবা আব্দুল হাই। সন্তান হারানোর শোকে মৃত্যুর আগে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন

এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিন হত্যা মামলায় দুই আসামীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। একই সাথে তাদের দেড় লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার আসামী জাকির হোসেনের উপস্থিতিতে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিজ্ঞ বিচারক সুদীপ্ত দাশ এ আদেশ দেন। দন্ডপ্রাপ্তরা হলো-হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের দিদার হোসেনের ছেলে জাকির হোসেন (২৫) ও পাটলী গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে সিএনজি চালক নূর আলম। দন্ডিত নূর আলম পলাতক রয়েছে। মামলার অপর আসামী রুবেল মিয়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় শিশু আদালতে তার বিচারকার্য চলছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট চৌধুরী আশরাফুল বারী নোমান।
মামলার বিরবণ ও আদালত সূত্র জানায়, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আব্দুল হাই’র মেয়ে এবং রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০২০ সালের এসএসসি পরিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিনকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল একই গ্রামের জাকির হোসেন। কিন্তু জেরিন তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে প্রায় সময়ই উত্ত্যক্ত করতো জাকির। এই বিষয়টি জাকির হোসেনের পরিবারকে অবগত করেন জেরিনের বাবা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেরিনকে অপহরণের পরিকল্পনা করে জাকির। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নূর আলমের সিএনজি অটোরিক্সায় করে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল জেরিন। আগে থেকেই গাড়িতে ছিলো রুবেল। পথিমধ্যে সিএনজি অটোরিক্সাতে তোলা হয় জাকিরকে। সিএনজি অটোরিক্সাটি জেরিনের স্কুল পেরিয়ে গেলেও তাকে নামিয়ে দেয়া হয়নি। এ সময় নামার চেষ্টা করলে জেরিনের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হয় অপহরণকারীদের। এক পর্যায়ে সিএনজি অটোরিক্সা থেকে জাকির তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে জেরিনের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ আড়াইশ’ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জানুয়ারি সকালে মারা যায় জেরিন। প্রথমে এ ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে পুলিশ এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জাকিরকে গ্রেফতার করে।
পরবর্তীতে ৩০ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে কবর থেকে জেরিনের লাশ উত্তোলন করে ময়না তদন্ত করা হয়। এর আগে জেরিনের বাবা আব্দুল হাই বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ প্রেক্ষিতে মামলার প্রধান আসামী জাকির হোসেন ও নূর আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জাকির হোসেন ও নূর আলম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার তৎকালীন ওসি মোঃ মাসুক আলী ২০২১ সালের ১৮ মার্চ আদালতে জাকির হোসেন, নূর আলম ও রুবেল মিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন। এ মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়।
মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে জেরিনের চাচা প্রাক্তন শিক্ষক আব্দুল মতিন জানান-ঘাতকরা নির্মমভাবে আমার ভাতিজিকে হত্যা করে। হত্যার পর আমার ভাই আব্দুল হাই তার মেয়ে জেরিনের খুনের বিচারের জন্য মামলার প্রতি তারিখেই আদালতে আসতেন। মেয়ের খুনীদের বিচার দেখে যাওয়ার জন্য প্রায়ই পাগলের মতো প্রলাপ করতেন। কিন্তু ২০২৩ সালের ৯ জুন আমার ভাইটি মৃত্যুবরণ করেন। মেয়ের খুনের বিচার দেখে যেতে পারলেন না আমার ভাই। তবে আদালত হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশ দেওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। উচ্চ আদালতেও যেন এই রায় বহাল থাকে। তিনি বিচারক, পুলিশ কর্মকর্তাসহ আইনজীবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে জেরিনের চাচাত ভাই শিক্ষানবিশ আইনজীবী আব্দুল মুবিন মিজান জানান, জেরিন আমাদের পরিবারের খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল। আমার চাচার স্বপ্ন ছিল জেরিন ডাক্তার হবে। কিন্তু ঘাতকরা তা হতে দিল না। তবে আদালতের রায়ে আমাদের পরিবার সন্তুষ্ট এবং মামলার পলাতক আসামী নূর আলমকে গ্রেফতার করে এ রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট চৌধুরী আশরাফুল বারী নোমান জানান, জেরিন স্কুলে যাবার পথে আসামীরা তাকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু অপহরণে ব্যর্থ হয়ে তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় জেরিনের বাবা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত শেষে ৩ জন আসামীর বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয় এবং দুই জন আসামী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এই মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। বিজ্ঞ আদালত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৭ ধারায় জাকির হোসেন ও নূর আলমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং উভয় আসামীকে দন্ডবিধি ৩০২ ধারায় ফাঁসির আদেশ দেন। এছাড়াও তাদের দেড় লাখ টাকা অর্থদন্ডের রায় দেন বিচারক।
উল্লেখ্য, নিহত মদিনাতুল কুবরা জেরিন রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম ছাত্রী ছিল। সে ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এছাড়াও জেরিন পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস এবং বৃত্তি লাভ করেছিল।