ওলন্দাজ বললেই আন্দাজে আসে জলদস্যুদের কথা, ওলন্দাজ জলদস্যু
জালাল আহমেদ

শিফল এয়ারপোর্ট থেকে মাইক্রোবাসে মালপত্র তুলে রওয়ানা দিলাম। যেদিকে তাকাই চোখ আটকে যাচ্ছে। চারিদিকে উজ্জ্বল সবুজের সমারোহ, গাড়ি থেকে ইউরোপীয় সামার দেখছি, তবে উত্তর ইউরোপীয়, এটা তখনো ভালো করে বুঝি নাই। নেদারল্যান্ডস সম্পর্কে সবাই যা জানে তা’ জানতাম। নেদারল্যান্ডস এর অধিবাসীদের আমরা ডাচ বলে জানি। সপ্তদশ শতকে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সংগে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গিয়ে ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় কলোনী বানায়। ডাচদের ওলন্দাজও বলা হয়, কিন্তু ওলন্দাজ বললেই আন্দাজে আসে জলদস্যুদের কথা, ওলন্দাজ জলদস্যু। নেদারল্যান্ডস উত্তর ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ, যে দেশ সমুদ্র সমতলের চেয়ে নিচে অবস্থিত। এর উত্তরে ও পশ্চিমে উত্তর সাগর, দক্ষিণে বেলজিয়াম এবং পূর্বে জার্মানি।
ইউরোপীয় এই দেশটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং এর প্রায় ৫% লোক প্রবাসী। ফলে প্রবাসী আয় নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সমুদ্র সমতলের চেয়ে নিচের একটা দেশ কিভাবে উন্নত দেশের পরিচয় নিয়ে বর্তমান, সেখান থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে। নেদারল্যান্ডস মানে হল লো-লায়িং কান্ট্রি, নিচু ভূমির দেশ। হল্যান্ডের অংশবিশেষ এর প্রাচীন নাম, উডল্যান্ড বা বনভূমি। অতীতে জলমগ্ন নিচু এই এলাকার যে অংশে বনভূমি বা উডল্যান্ড ছিল তার নাম হল্যান্ড। এখনো একটি প্রদেশের নাম নুরদ-হল্যান্ড বা নর্থ হল্যান্ড আরেকটি জিউড-হল্যান্ড বা সাউথ হল্যান্ড। নেদারল্যান্ডসের বাকি অংশ সমুদ্র সমতলের নিচে। এই কথাটা সবসময় শুনে এসেছি কিন্তু দেখার আগে ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি।
ঘন্টাখানেক ভ্রমনের পর ভাগেনিংগেন শহরে এসে পৌঁছাই। ছোট্ট শহর, বিখ্যাত মূলত তার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই। আমাদের থাকার ব্যবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আবাসে, নাম ভাগেনিংগেন ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার (ডাব্লিউআইসিসি)। বেশ বড় ভবন, ৮/১০ তলা হবে, বাইরের দিকটা হোটেলের মত। কিন্তু এটা একই সংগে ছাত্রাবাসও। আমাদের দলের কেউ তখন হোটেলে নেই। ২২ মে ১৯৯৭, ভ্রমনসূচী অনুযায়ী সবাই আমস্টারডামের কোকেনহাফ গেছে। জগতখ্যাত টিউলিপ প্রদর্শনীর শেষদিন ছিল ঐদিন। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকবো দেখি যে দরজা আমাকে দেখে নিজে থেকেই খুলে গিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় দরজার সংগে সেদিনই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। টপ ফ্লোরে আমার পছন্দসই একটা রুম পেলাম।
একটু বিশ্রাম নেবার আগে দ্রুত হালকা দুপুরের খাবার সেরে ফেললাম। বিকেলে আশেপাশে ঘুরতে বের হব, বের হয়ে দেখি ঠা ঠা রোদ্দুর, সামারের নেদারল্যান্ডস। চারপাশে একটু হেঁটে আবার হোটেল কক্ষের আশ্রয়ে। ঘড়ির কাঁটায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা কিন্তু আকাশে এর কোন লক্ষন নেই। পর্দা সরালে ঝকঝকে রোদ্দুর। রাতের খাবার কখন খাবো তাই ভাবছিলাম। সাড়ে সাতটার পর নেমে নিচে ডাইনিং এ গেলাম। গিয়ে দেখি ডাইনিং বন্ধ! বন্ধ কেন? অনুসন্ধানে জানলাম যে সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনার টাইম শেষ। কি করা যায়? বের হলাম কোন খাবার দোকান পাই কিনা? আশেপাশে হেঁটে হেঁটে দেখি সব দোকান পাট বন্ধ, রূপকথার মৃতপুরীর মত অবস্থা। রাস্তার পাশে পার্ক করা সারি সারি গাড়ী কিন্তু জীবনের লক্ষন খুব একটা চোখে পড়ে না।
কিছুদুর হেঁটে হোটেলে ফিরে আসলাম। কিন্তু না খেয়ে তো শবগুজার করা যাবে না। আর তখন গুগল ম্যাপের যুগও না যে আশেপাশের সব খাবার দোকান খুঁজে পেয়ে যাব। আবার বের হলাম খাবারের খোঁজে! এবার একটু বড় সার্কেল নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। এক ট্রাফিক সিগনালের পাশে দেখি ফুটপাতের উপর একটি সোফাসেট, একটি ডাবল ম্যাট্রেস আর একটি ছোট্ট ফ্রিজ রাখা। বুঝলাম যে কেউ তুলে নিয়ে যাবে এই আশায় কেউ ফেলে গিয়েছে। ছোট্ট শহর, হাঁটতে হাঁটতে শহরের কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম। শহর কেন্দ্রও মৃতপুরী, সবগুলো দোকানপাট বন্ধ। রাস্তাগুলো কেবল পথচারীদের জন্য সরব। এক দুইজন লোক হেঁটে যাচ্ছে আর সবাই যে উবে যায়নি তা প্রমাণের চেষ্টা করছে।
গলিঘুঁজিতে হেঁটে আচমকা খরিদ্দারবিহীন এক খাবার দোকান খোলা পেয়ে গেলাম। শুধু যে খাবার দোকান তা’ না, ঢুকে দেখি হিন্দি গানও বাজছে! বললাম যে ভাত আছে কি না, বললো সব গুটিয়ে ফেলেছে তবে ভাত, মুরগীর সালুন আর ডাইল দিতে পারবে! বাঙালির আর কি লাগে! দেশের বাইরে প্রথম রাতের খাবার ডাল-ভাত-মুরগী দিয়ে সেরে ফেললাম। জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ি কই? বললো সুরিনাম। সুরিনাম এর নাম কয়জনেই বা শুনেছে কিন্তু ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে এন্থনী নেষ্টি সাঁতার কেটে সোনার পদক পেয়ে তখন সুরিনামকে কিছুটা পরিচিত করেছেন। তাও ধন্ধ কাটেনা।
সুরিনাম ওলন্দাজ কলোনী ছিল এটুকুও জানতাম। বললো যে তাঁর প্রপিতামহকে আখ খেতে কাজ করার জন্য ভারত থেকে সুরিনামে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ভারতীয় উত্তরাধিকারে বংশানুক্রমে হিন্দি গান নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত চলে এসেছে। ডিনার খেয়ে বের হলাম রাত সোয়া দশটায় কিন্তু তখনো আকাশ জুড়ে ইউরোপিয়ান সামারের সূর্যালোক আর জানালায় ভারী পর্দা টেনে ওলন্দাজরা গভীর ঘুমে পরদিনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গভীর রাতের নরম রোদে আবার হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরে এসে দলের বাকি ১২ জনের সংগে দেখা হল।
দলনেতা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব, হিসাব ও নিরীক্ষা ক্যাডারের ১৯৭৭ ব্যাচের দুলাল আবদুল হাফিজ। আরো আছেন পানি সম্পদ মন্ত্রীর একান্ত সচিব আমার ব্যাচমেট আরিফুর রহমান (বহু আগেই চাকুরী ছেড়ে দিয়ে মাস্টারী করতেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও ছিলেন) সহ অন্যরা। এসে খবর পেলাম যে পরদিন জেলা প্রশাসক কেএমডি আবুল কালামও আসছেন। পরদিন আমাদের ভিন্ন প্রোগ্রাম ছিল। সিদ্ধান্ত হল যে আমরা আমাদের প্রোগ্রাম অনুসরণ করবো আর হোস্ট প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ভূমি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন ইন্সটিটিউট (আই আই এল আর আই) এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁকে রিসিভ করে এখানে নিয়ে আসবেন।