মামলার আলামত এক জটিল বিষয়
রামের মামলার আলামত শ্যামের মামলায় আর যদুর মামলায় জব্দকৃত মাল মধুর মামলায় নিয়ে গিয়ে হাজির করার কারণে কত মামলা যে নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই
জালাল আহমেদ
আমার এমএম এবং সিএমএম থাকাকালীন সাত বছরের কোর্ট পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল বৈচিত্রময়। সম্ভবতঃ ১৯৯৪ সালের কথা, শুল্ক আইনের একটি মামলায় জব্দকৃত একটি বোটের জিম্মার আবেদন শুনানীর জন্য আমার কাছে আসে। মামলার আসামী জামিনে ছিল এবং সেই ছিল বোটের মালিক। শুল্ক মামলায় বোট মামলার আলামত কিন্তু অযতেœ পড়ে থাকলে এই মূল্যবান সামগ্রীটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই বিবেচনায় আমি বোটটি আসামীর জিম্মায় প্রদান করি। এতে সরকার পক্ষ অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ হয় ও আমার আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে রিভিশন পিটিশন করে। বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ জিম্মা প্রদানের বিষয়ে আমার আদেশ বহাল রাখেন। তখন শুল্ক কর্তৃপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন দাখিল করে। এটা একটু অস্বাভাবিক ছিল কিন্তু মহামান্য হাইকোর্টও জিম্মার আদেশ বহাল রাখে এবং নিম্ন আদালতকে তা’ বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রদান করে।
এদিকে শুল্ক কর্তৃপক্ষ সময়ক্ষেপন করতে থাকে। আমি যখন জিম্মা প্রদান ও আদালতকে অবহিত করার জন্য শেষ তারিখ প্রদান করি তখন শুরু হয় বিভিন্ন স্থান থেকে তদবির। একপর্যায়ে শুল্ক কর্তৃপক্ষ আদালতের কাছে স্বীকার করে যে বোটটির অস্তিত্ব বাস্তবে নাই। কিভাবে সম্ভব! বোটটি শুল্ক কর্তৃপক্ষের জেটিতে ছিল। তারা এই বোটটি অন্য একটি অভিযানে ব্যবহার করে এবং এক পর্যায়ে বোটটি চড়ায় উঠে যায়। ঐ অবস্থায় তারা বোটটি নিলামে বিক্রি করে দেয়। এক্ষেত্রে আদালতের পূর্বানুমতি নেয় নাই বা আদালতকে অবহিত করে নাই। এটা সম্পূর্ণ একটা নতুন টুইস্ট এবং এই তথ্য গোপন রেখেই তারা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আর মহামান্য হাইকোর্টে গিয়েছে। তখন আমি যথাযথভাবে সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করে কমিশনার কাস্টমস এর বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না সে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলাম।
কমিশনার কাস্টমস ছিলেন ১৯৭০ সালের সিএসএস, বিভাগীয় কমিশনার ওমর ফারুক এর ব্যাচমেট। তিনি কমিশনারকে ধরলেন, কমিশনার আমাকে ডাকলেন তাঁর অফিসে। কমিশনারকে আদালতে না এনে কিছু করা যায় কিনা এই কথা বললেন। আমি পুরো বিষয় বর্ণনা করে বললাম যে স্যার বিষয়তো উনারা নিজেরাই মহামান্য হাইকোর্টে নিয়ে গিয়েছেন, এই পর্যায়ে কিছু করনীয় নাই। তবুও এক তারিখ আমি সময় দিলাম কিন্তু তারাও আমার প্রাথমিক আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবার সাহস করলেন না। পরবর্তী তারিখে আদেশনামায় বিস্তারিত বিষয় লিপিবদ্ধ করে ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা আইনের অধীনে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নথি মহামান্য হাইকোর্টে প্রেরণ করলাম।
আবারো এক শুল্ক মামলার কাহিনী। চট্টগ্রামের বন্দর ও পতেংগা থানার মামলার একটা বড় অংশই ছিল শুল্ক আইনের অধীনে। এমনই এক মামলায় পুলিশ এক আসামীর ঘর থেকে বিপুল পরিমাণ ভিসিপি উদ্ধার করে। জব্দনামা প্রণয়ন করে, মালামাল জব্দ করে ও মামলা রুজু করে। মামলার তদন্ত সমাপ্তির পর পুলিশ এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত তা গ্রহণ না করে মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ প্রদান করে। কিছুদিন পর দীর্ঘদিন আদালতে কাজ করা দারোগা জাহিদ এসে আমাকে বলে যে স্যার, এই মামলাটায় আবারো চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসবে। তদন্তকারী অফিসার প্রতিবেদন গ্রহনের জন্য অনুরোধ করছে। তাকে ডাকলাম, বললাম যে একটা ঘর থেকে মালামাল উদ্ধার হয়েছে, ঘরের মালিক বা ভাড়াটিয়া কেউ না কেউ থাকবে। এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয় কিভাবে?
বাস্তবে তাই হল। চট্টগ্রাম আদালতে অত্যন্ত ভালো একজন কোর্ট ইন্সপেক্টর ছিলেন শাহ আলম, তাঁকে আমি পরে ঢাকা সিএমএম কোর্টে সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসাবে পেয়েছি। আমি তাঁকে নির্দেশ দিলাম থানায় গিয়ে এই মামলাটির বিষয় অনুসন্ধানের জন্য। ইন্সপেক্টর শাহ আলম থানায় গেলেন এবং চমকপ্রদ তথ্য উদ্ঘাটন করে ফিরে আসলেন। থানার রেজিস্ট্রারে লিখা আছে যে এই মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে, বাস্তবে এসেছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট। অর্থাৎ আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তাদের সবার স্বাক্ষর জাল। তখন আমার সন্দেহ হল আলামত নিয়ে, আলামত কোথায়? রেকর্ড অনুযায়ী আলামতের নমুনা রেখে বাকিগুলো শুল্ক বিভাগে জমা দেয়া হয়েছে। যখন শুল্ক বিভাগে খোঁজ নেয়া হল জানা গেল যে শুল্ক বিভাগে কোন আলামত জমা হয় নাই। বাস্তবে আলামত কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। ঐ দারোগার বিরুদ্ধে নিয়মিত পুলিশ মামলা রুজু করার আদেশ দিলাম। এই ফাঁকে সে পালিয়ে গেল, এমনকি জানা গেল যে সে দেশ ত্যাগ করেছে।
মামলার আলামত আরেক জটিল বিষয়। গল্প শোনা যেত যে ঢাকা কোর্টের মালখানার সব বিলাতী মদ ইঁদুরে খেয়ে ফেলতো। চট্টগ্রাম কোর্ট মালখানার অবস্থাও ছিল তথৈবচ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম আদালতের কমন আইটেম ভিসিআর/ভিসিপি ও বিদেশী সিগারেটের ক্ষেত্রে এই চিত্র ছিল সাধারণ। রামের মামলার আলামত শ্যামের মামলায় আর যদুর মামলায় জব্দকৃত মাল মধুর মামলায় নিয়ে গিয়ে হাজির করার কারণে কত মামলা যে নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্ত্বা নাই। এর অন্যতম কারণ ছিল একই আলামত সব মামলায় নিয়ে হাজির করা হত। মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রেও তাই ছিল অবস্থা। বোতলের মদ যেত ইঁদুরের পেটে! আমার সময়কালেই মালখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত দারোগা বদলী হলেন, নতুন স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তা একটু বোকা কিসিমের। তিনি রেজিস্ট্রার দেখে সব মাল বুঝে নিবেন, নয় মাস লাগলো দায়িত্ব হস্তান্তরে। এরমাঝে আমি বদলী হয়ে চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী। তবে আমার বদলিও অত সহজে হয়নি, সেই কাহিনী আসছে পরে।
মোটরযান আইনে মোটরযান চালনার লাইসেন্স দেবার জন্য একটি বোর্ড কাজ করে। জেলা পর্যায়ে এই বোর্ড এর সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। আর মহানগরের ক্ষেত্রে মূখ্য মহানগর হাকিম বা সিএমএম সভাপতি এবং তাঁর পক্ষে একজন মহানগর হাকিম বা মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট এই দায়িত্ব পালন করেন। আমি চট্টগ্রাম থাকাকালে ৪ বছরেরও বেশি সময় এই দায়িত্ব পালন করেছি ফলে চট্টগ্রামের বলতে গেলে প্রায় সকল ড্রাইভার আমকে চিনত। আর ঢাকা’র সিএমএম হিসাবেও আইনগতভাবে তিন বছর এই দায়িত্ব পালন করেছি। এই দুই মহানগরীতে ৭ বছরে হাজার হাজার লাইসেন্স প্রদানের সংগে আমি যুক্ত ছিলাম। চট্টগ্রামে মাসে প্রথমে কমপক্ষে একটি বোর্ড করা হত, কোন মাসে দুইটি, পরে মাসে চারটি বোর্ডও করা হয়েছে। ১৯৯৪ সাল থেকে সহজ প্রশ্নে লিখিত পরীক্ষা নেয়া শুরু হয়। প্রথম দিনের লিখিত পরীক্ষা দিতে আসলেন চট্টগ্রামের ডিআইজি কুতুবউদ্দিন, তিনি এক সময় হবিগঞ্জের এসডিপিও ছিলেন। সহকারী দারোগা থেকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ডিআইজি পর্যন্ত হয়েছিলেন এবং সারাজীবন সুনামের সংগে চাকরি করে গিয়েছেন।