জালাল আহমেদ
এডিসি আবদুল হাই স্যারের বাসা ছিল আমাদের ভিসিআর দেখা আর আড্ডার জায়গা

১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সদর মহকুমা বাদে দেশের ৪৬টি মহকুমার ৪২টি কে জেলায় উন্নীত করা হয়। বাদ পড়া দুর্ভাগা ৪টি মহকুমা হল রামগড়, কাপ্তাই, লামা এবং পটিয়া। সদর মহকুমাগুলো স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হয়ে গেল। তিনটিই পার্বত্য জেলাসমুহে, একটি চট্টগ্রামে, আর ৪টিই দেশের দক্ষিণপূর্ব কোনে। সেগুলো মহকুমা থেকে উপজেলায় রুপান্তরিত হলো। মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেলো মহকুমার সীমানা, প্রশাসনিক পদবিন্যাস থেকে ১৪০ বছর পর মহকুমা প্রশাসক পদবী বিলুপ্ত হল। খাগড়াছড়ি জেলায় ৮টি উপজেলা ছিল (বর্তমানে গুইমারা সহ ৯টি)। ইউএনও ছিলেন রামগড়ে নুর মোহাম্মদ, লক্ষিছড়ি সুলতান আহমেদ মজুমদার, মানিকছড়ি আব্দুল হক, মাটিরাংগা কাজী ফরিদ আহমেদ, খাগড়াছড়ি সদর ছমিরউদ্দিন আহমেদ, মহালছড়ি মতিউর রহমান, পানছড়ি মোঃ রফিকউদ্দিন মোল্লা। দীঘিনালা’র ইউএনও ১৯৭৩ ব্যাচের তাজুল ইসলামের পদায়ন হয় খাগড়াছড়িতে এডিসি হিসেবে। দীঘিনালাতে আসেন এজেএম হাফেজ।
এর মাঝে জানুয়ারী মাসে এক ঘটনা ঘটে। বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে কোন মিটিং চলছিল, সে সময় খবর আসে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের তিন বছরের মেয়ে আজমেরী তাঁদের সার্কিট হাউজস্থ ঢাকার বাসায় ট্রাইসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। ছেলে হওয়ার ১৮ বছর পর বহু সাধনার ধন এই মেয়ে। আজমীর শরীফের বরকতে পেয়েছেন বলে তিনি মনে করায় নাম রেখেছেন আজমেরী। জেলা প্রশাসক মহোদয় আর অফিস বা বাসায় না ফিরে ব্রিগেড থেকেই হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে ঢাকা চলে গেলেন। তিনি আর খাগড়াছড়ি ফিরে আসেননি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এএমএম রেজা ই রাব্বি দায়িত্বে ছিলেন। কিছুদিন পর ব্যাচের তালিকায় পেছনে থাকলেও ইপিসিএস ১৯৭০ ব্যাচ থেকে তিনিই প্রথম জেলা প্রশাসক হয়ে গেলেন। জনাব মাইজুদ্দিন আহমেদ ছিলেন ফেনীর লোক, নিপাট ভদ্রলোক, মাঠ প্রশাসনে অভিজ্ঞতা কম ছিল কিন্তু দায়িত্ব পালনে সাহসী ছিলেন। এসজেডএমএলএকে বলতেন যে বেসামরিক প্রশাসন ২০০ বছর থেকে যে কাজগুলো করে আসছে সেগুলো যেন নতুন করে শিখাতে না যান। বেসামরিক প্রশাসন তার কাজ করুক। তিনি সৃজনশীল মানুষ ছিলেন, গল্প-কবিতা লিখতেন। ১৯৮৯ সালে আমার বিয়ের দাওয়াতের জবাবে একটি কাব্য উপহার লিখে পাঠিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসক এর কনফিডেনশিয়াল এসিস্ট্যান্ট (সিএ) বা গোপনীয় সহকারী ছিলেন রাঙ্গামাটি থেকে আসা আজিজুল হক। অত্যন্ত দক্ষ একজন সহকারী, তখনকার সকল সিএ দের মতোই শর্ট হ্যান্ড এ পাকা, বুদ্ধিমান, দক্ষ ও আইন কানুনে অভিজ্ঞ। তাঁর কাছে অনেক কিছুই শেখার ছিল, মাতব্বরিটুকু ছাড়া।
আমি আগে উল্লেখ করেছি যে ব্রিগেড সদরে আমার কন্টাক্ট ছিলেন ব্রিগেড মেজর ও ডিকিউ, মেজর হায়দার ও মেজর নজরুল। মেজর হায়দার এর অভ্যাস ছিল বদমেজাজী ব্রিগেড কমান্ডারের সামনে নার্ভাস হয়ে গেলে ইউনিফর্ম টেনে টেনে সমান করতেন। আর মেজর নজরুল কমান্ডারের নির্দেশ কিছু বুঝতে অসুবিধা হলেই আমাকে ডাকাডাকি করতেন। জেলা প্রশাসকের রুমে ফোন করেও আমাকে যাবার জন্য খবর দিতেন। আমি গিয়ে স্টাফকে ডেকে সহজেই উদ্দিষ্ট কাগজ বা বিষয় বের করে দিতাম। জেলা প্রশাসক মহোদয় কখনো কখনো একটু বিরক্তই হতেন। তার ফল হলো এক লম্বা কবিতা, শর্ত ছিল যে শেয়ার করা যাবে না, ৩৭ বছর পর এর অংশবিশেষ, যেটুকু স্মৃতিতে আছে তুলে ধরছি:

“বিএম লাফিয়ে ছুটে ডিকিউ ঘামায়
ঘন ঘন হাত মুছে নিজের জামায়।
কেরানী সামনে এসে নথিটি দেখায়
পেয়েছি পেয়েছি বলে সবাই চেঁচায়!”

এরমাঝে আরো কয়েকজন নতুন কর্মকর্তা এসে যোগ দিলেন আমাদের টিমে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নবসৃষ্ট ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেট পদে ১৯৮১ ব্যাচের চট্টগ্রামের ওয়াহিদুন্নবী চৌধুরী, ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের ফেনীর আনওয়ারুল করিম ও চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ইসহাক, ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের সদ্য প্রয়াত ফেনীর শামসুল কিবরিয়া চৌধুরী, কুমিল্লার নজরুল ইসলাম, এ এন হাফেজ আহমেদ ও সিলেটের আহমেদ হোসেন। সদর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবুল হাশেম (তিনি খাগড়াছড়িতে বসে পানছড়ি উপজেলার কোর্টও করতেন)। আবুল হাশেম বয়স্ক মানুষ, রসিকতা কম বুঝতেন, খেপে যেতেন। তবে দীর্ঘদিন আমাদের মেস ম্যানেজার এর জটিল দায়িত্ব সামলেছেন। প্রতিমাসেই দায়িত্ব বদল হবার কথা, মিটিং এ বসলেই সব ভোট আবুল হাশেম এর পক্ষে, ফলে আমাদের মেসের স্থায়ী ম্যানেজার হয়ে যান। নতুন এডিসি এলেন ১৯৭৩ ব্যাচের একেএম গোলাম ফারুক, তিনি যেহেতু একা থাকবেন তাই তাঁর ঠিকানা হলো আমাদের মেস বাংলোতে, আমার যে বড় রুম ছিল সেখানে। নতুন জেলা প্রশাসক পরিবার নিয়ে আসাতে আমি আবার আমার পুরনো আস্তানায় একটি ছোট রুমে ফিরে এলাম।
নতুন আরো একজন এডিসি এলেন মোঃ আব্দুল হাই, তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম এর লঙ্গদু ও কুমিল্লা’র মুরাদনগরের ইউএনও, সপরিবারে উঠলেন অতিরিক্ত এসডিও’র বাংলোতে। আমাদের আরেকপাশের বাংলোতে এডিসি তাজুল ইসলাম সাহেব সপরিবারে। দু’জনেই ছিলেন দক্ষ, সাহসী ও অভিভাবকসুলভ কর্মকর্তা। আবদুল হাই স্যারের বাসা ছিল আমাদের ভিসিআর দেখা আর আড্ডার জায়গা। ভাবি ভালো হোস্ট ছিলেন আর তখন ভিসিআর নতুন যদিও সাধারণভাবে হিন্দি ছবি আমার তখনো পছন্দ ছিল না, এখনো না। পাহাড়ের মাঝামাঝি লেডিস ক্লাবে সপরিবারে উঠলেন আহমেদ হোসেন, ভাবি যোগ দিলেন নতুন কুঁড়ি কিশলয় স্কুলে। কোন আবাসনই মানসম্পন্ন ছিল না, ইম্প্রোভাইজড একমোডেশন যাকে বলে। তার মাঝেই সবাই মিলেমিশে ভালোই সময় কাটছিল। আমাদের মেস কুক তসলিম খুব ভালো রান্না করতো। সে আগে ব্রিগেড মেসে রান্না করতো ফলে বৈকালিক নাস্তাও খুব ভালো বানাতো। তবে এডিসি গোলাম ফারুকের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া সকলের জন্যই ছিল খুব কঠিন, তাই মাসখানেক পর তাঁর রান্নার আলাদা ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।