জালাল আহমেদ
সুনামগঞ্জের ভাটিপাড়ায় এডিএম জিল্লুর চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরশাদ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ অবস্থা ও সামরিক উপস্থিতির গতি প্রকৃতি বুঝে উঠতে শুরু করলাম। এদিকে জেলা প্রশাসক পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে তখনো দেখা করা সম্ভব হয়নি কারণ আমিতো সরাসরি মহকুমা সদরে যোগদান করেছিলাম। তাই সেপ্টেম্বর মাসে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য রাঙ্গামাটি যাবার অনুমতি নিলাম। চান্দের গাড়ীতে হাটহাজারী গিয়ে ওখান থেকে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটির বাসে রাঙ্গামাটি গেলাম। সময়টা বর্ষার পর পর হওয়ায় পাহাড় ছিল সবুজ শ্যামল আর লেক ভর্তি ছিল ভাসা পানি। পাহাড়ে বেড়ানোর জন্যও আমি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস এ কারণে পছন্দ করি। এর আগে এসেছিলাম ১৯৭৬ এর জুলাই মাসে, ভরা বর্ষায়। রাঙ্গামাটি পৌঁছে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জেলা প্রশাসক জনাব এম এ মালেকের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আগেও রাঙ্গামাটিতে চাকুরী করেছেন, অভিজ্ঞ কর্মকর্তা, জেষ্ঠ ইপিসিএস, বাড়ী নোয়াখালী। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ছিলেন জনাব জিল্লুর রশীদ চৌধুরী, সম্ভবতঃ ১৯৭০ ব্যাচের লইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট, পান খেতেন খুব। তাঁর বাড়ী ছিল সুনামগঞ্জের ভাটিপাড়া। তাঁদের বাড়ীতে উচ্চপদস্থ লোকজন শীতকালে যেতেন হাওরে পাখি শিকারে আর বর্ষায় মাছ শিকারে। তাঁদের বাড়ীতে এক সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গিয়েছেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাস্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও গিয়েছিলেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক ও রিলিফ) ছিলেন জনাব শফিকুল ইসলাম, শেষ ব্যাচের সিএসপি, পরে রাঙ্গামাটির ডিসি, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। MD Enamul Kabir স্যার ও ছিলেন সম্ভবত। এক সময়ে হবিগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আব্বাকে ভালো জানতেন, আমার প্রতি ছিল আন্তরিক স্নেহ।
রাঙ্গামাটি ডিসি অফিস ঢালু ছাদের একটি আধুনিক ভবনে অবস্থিত ছিল। ২০১৮ সালে আমার সর্বশেষ সফরের সময়েও ভবনের অবস্থা খুব ভালো দেখেছিলাম। তখন পুরনো ডিসি অফিসে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অফিস। পুরনো অফিস ছিল টিনশেড কাঠের ফ্রেমে বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরী। চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সৃষ্টি। প্রথম সদর স্থাপিত হয় চট্টগ্রাম জেলার সীমানা সংলগ্ন চন্দ্রঘোনাতে। চন্দ্রঘোনা আমাদের যুগে পরিচিত ছিল পাকিস্তানের প্রথম কাগজের কলের জন্য। মাগুরা’র আখের ছোবড়ার সাদা কাগজের আগে আমাদের একমাত্র কাগজ ছিল কর্ণফুলী কাগজ। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ ছিল উত্তরপূর্ব পাহাড়ি এলাকা থেকে কুকী ও লুসাইদের নিয়মিত আক্রমণ প্রতিহত করা। কুকি ও লুসাইরা নিয়মিতই পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় হামলা করতো, তাদের কোন কোন গোত্র হেড হান্টার’ও ছিল। ১৮৬০ থেকে কয়েক বছর ক্যাপ্টেন ম্যাকগ্রাথ চট্টগ্রামের কাছে চন্দ্রঘোনা থেকেই সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত কিংবদন্তিতূল্য জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টমাস হারবার্ট লেউইন নোয়াখালীর পুলিশ সুপারের দায়িত্বভার ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের দায়িত্বভার গ্রহন করেন।
তখনো জেলা সদর চন্দ্রঘোনা এবং চাকমা রাজার বাড়ী রাঙ্গুনিয়া’র রাজাবাড়ীতে। যারা এটুকু জানতেন না তাঁদের জন্য তথ্য, চাকমা রাজবাড়ি এক সময় ছিল রামুতে, এরপর আলীকদমেও ছিল কিছুদিন। আরাকান থেকে চাকমারা এভাবেই ধীরে ধীরে দক্ষিন থেকে উত্তরে আসতে থাকে। শেষ “স্বাধীন” চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ’র মৃত্যুর পর রাজত্ব কয়েকবছর কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর দায়িত্বে থাকে, রাজা ধরম বক্স খাঁ’র পতœী বিখ্যাত রানী কালিন্দী প্রথমে ইজারা ও পরে দায়িত্ব লাভ করেন। লেউইন এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুরু হয় টানাপোড়েন দিয়ে এবং এতে রানীর ক্ষতিই হয়। লেউইন এর অন্যতম কাজ ছিল জেলা সদর সরিয়ে নেয়া। তিনি কর্ণফুলী নদীর অনেক উজানে, বর্তমান রাঙ্গামাটিতে সদর স্থানান্তর করেন। জেলা প্রশাসকের বর্তমান বাংলোর স্থানেই তিনি সদর স্থাপন করেন। যারা ওখানে গিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন স্থানটি একটি উপদ্বীপের সমতুল্য, নদীর একটি ‘হর্স শু’ বাঁক এর উপরে। নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল এখানে সবার আগে বিবেচ্য ! এখন নদীর বাঁক বা এর ‘লুক আউট’ পজিশন বুঝা যায় না লেকের জন্য। কিন্তু চারিদিকে লেকের পানির অপার সৌন্দর্য ঠিকই চোখে পড়ে।
লেউইন তাঁর আত্মজীবনী A fly on the wheel এ লিখেছেন, “The position of my new head-quarters was quite central. It was situated on a bend of the river Karna-phuli, which at this place makes a sort of loop…… my own house was placed on a lofty cliff overhanging the river, and commanding a beautiful and extended view on all sides” অর্থাৎ এই লুকআউট থেকে লেউইন প্রায় ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ পেতেন। তাঁর নির্দেশে বিশ মাইল বৃত্তের মাঝে সকল উপজাতির তিনশো শ্রমিক “built me a large house, Lushai fashion, on the spot I selected. It was built entirely of bamboo, except the posts, which were huge logs of unhewn timber, and the floor, which was constructed of small saplings about two inches in diameter laid lengthwise”
আবার ফিরে যাই ডিসি অফিসে। এনডিসি’র দায়িত্বে ছিলেন ১৯৮১ ব্যাচের আ,ত,ম ফজলুল করিম, কবি আবু করিম হিসেবেও পরিচিত এবং এই কবিতার কারণেই তথ্য সচিব থাকাকালে চাকুরী ছেড়ে দিতে তিনি বাধ্য হন। ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের Akm Saiful Islam Chowdhury সহ আরো তিনজন ছিলেন জেলা সদরে। তাঁদের সংগেও দেখা হলো। অফিস থেকে যখন বের হবো তখন সিঁড়িতে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। দেখে চেহারা চেনা চেনা মনে হলো। সাদা শার্ট প্যান্ট পরা ভদ্রলোককে সালাম দিলাম, পরিচয় দিলাম। তিনি ডিসি সাহেবের ভাই। আমি বললাম আপনাকে চেনা মনে হচ্ছে, আপনি কি সিলেটে ছিলেন কখনো? তিনি বললেন যে সিলেটে ছিলেন। হবিগঞ্জে? হ্যাঁ! লাখাই তে? হ্যাঁ! লাখাই থানার বুল্লা বাজার তহশিলে তিনি তহশীলদার ছিলেন। আমাদের তহশীলদার স্যার, এম এ খালেক। ১৯৬৮ সালে যখন বুল্লা বাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি তখন তিনি বাজারে তহশীলদার। আমার নানাবাড়ির বাংলা ঘরে লজিং থাকেন আর আমাদের সকাল সন্ধ্যা পড়ানোর চেষ্টা করেন। পনের বছর পর এরকম দেখা হওয়ায় আমরা দুজনেই খুশী হয়েছিলাম। এ ঘটনার আরো বারো বছর পর ১৯৯৫ সালে আমি যখন এডিসি (রাজস্ব) নোয়াখালী তখন রামগতিতে তাঁর বাড়ীতে বেড়াতেও গিয়েছিলাম। রাতে থাকতে গেলাম এনডিসি সাহেবের সঙ্গে তাদের টিনশেড বাংলো মেসে। পরদিন হাটহাজারী হয়ে আবার খাগড়াছড়ি ফিরে আসি।