জালাল আহমেদ
প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ব্রিগেড মেস নাইটে আড্ডা গল্পগুজব তাম্বুলা খেলা হতো আর কখনো অন্য কিছু

বিএম হিসেবে পাই আমার দেখা সবচেয়ে স্মার্ট সেনা কর্মকর্তা মেজর ফারুক আশফাককে, তিনি পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ থেকে অবসরে যান। ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো (বিএটি)’র প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন, ২০১৭ সালে বিএটি সংলগ্ন রেললাইনে মারা যান। আত্মহত্যা? কে জানে!

জীবনে এতো বড় টিকটিকি দেখিনি। একটু পর সে আমার অবাক দৃষ্টি দেখেই হয়তো সিলিং এর আড়ালে চলে গেলো আর ডাক শুনলাম, এতো কাছ থেকে জীবনে প্রথম, তকখো, তকখো, তকখো! তখন বুঝলাম এটা তক্ষক। বলা হয়ে থাকে যে বয়স যতো তক্ষক ততোবার ডাকে, এখনকার সময় হলে তার ‘মূল্য এক কোটি টাকা মাত্র!’। পরদিন ১ সেপ্টেম্বর সকালে অফিসে গিয়ে বসলাম এবং দায়িত্ব বুঝে নিলাম। এরমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল জেল সুপারের দায়িত্ব। প্রধান সড়কে এসডিও অফিস পার হয়ে দিঘীনালা’র দিকে এগুলে হাতের ডানে থানা পাহাড়, বামে উঁচু জেল পাহাড়। পরবর্তীতে চেংগী সেতু হলে সেতু থেকে দিঘীনালা’র রাস্তা সোজা চলে যায়, শহরে আর ঢুকতে হতো না, যা এখন সাজেক রোডও বটে। যারা ঢাকা থেকে সাজেক যান তাঁরা এই পথ ধরেই যান। তবে খাগড়াছড়িতে এক সঙ্গে কাজ করেছেন আমার এমন এক সহকর্মীর দেয়া তথ্য মতে জনসাধারণের জন্য এখনো বাজার চৌরাস্তা হয়ে ডিসি অফিসের সামনের রাস্তাই এখনো প্রচলিত। জেলখানার দায়িত্ব মানে কারাগার, কারারক্ষী ও কারাবন্দীদের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করা। মাঝেমাঝে স্পর্শকাতর বন্দী যেমন থাকতো তেমনি জেল কোড অনুসরণ করে এই দায়িত্বপালনও ছিল স্পর্শকাতর।
ঐদিন থেকেই আরেকটি চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব অর্পিত হয় যা প্রায় এক বৎসর পালন করেছি তা হলো ওসি, বাজারফান্ড বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বাজারফান্ড। দ্য চিটাগাং হিল্ট্র্যাক্টস ম্যান্যুয়াল ১৯০০ অনুযায়ী জেলা প্রশাসক হলেন এডমিনিস্ট্রেটর বাজারফান্ড। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান এবং প্রধান সড়কের অপরদিকে এর আলাদা অফিস। বাজারফান্ড এর দায়িত্ব ছিল মিশ্র প্রকৃতির। এর মূল দায়িত্ব ছিল তৎকালীন দুই মহকুমা ও ছয় উপজেলার ৩৪টি হাট বাজারের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আর দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল খাগড়াছড়ি শহরের পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন, তখনো খাগড়াছড়ি পৌরসভার জন্ম হয়নি। আমার পানছড়ি অবস্থানকালে খাগড়াছড়ি পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর প্রথম চেয়ারম্যান হন বাদশা মিয়া সওদাগরের ছেলে জাহেদুল আলম।
দু’দিন পর রোববার, ছুটির দিন, সকালে গেলাম মাঠে অফিসার্স ক্লাবের পাশে শিল্পকলা একাডেমীতে। এসডিও সাহেব বলেছিলেন শিল্পকলা একাডেমীর একটু খোঁজখবর নিতে। তখন ক্লাশ চলছিল সঙ্গীত ও নৃত্যের। দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল কাওসার আলম, চাকুরী করতেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে এবং বেশ কয়েকবছর আগে অকালে প্রয়াত। আমার মুখ থেকে নিশ্চিত তখনো ছাত্রত্বের ছাপ মুছে যায়নি ফলে শিল্পকলার ছাত্র শিক্ষক কেউই বুঝতে পারছিলেন না যে আমি ম্যাজিস্ট্রেট। শিক্ষার্থীদের মাঝে এসডিও সাহেবের ছোট মেয়ে রুমুও ছিল ফলে পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেল। এই অভিজ্ঞতাই পরে আমাকে গাম্ভীর্যের মুখোশ পরতে শেখায় যা সরাতেও পরে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ব্রিগেডে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে আমার নিয়মিত কাজকর্ম চলতে থাকে।
পূর্ববর্তী সভার রেজুলেশন লিখে জমা দেই, ব্রিগেড কমান্ডার অনুমোদন করেন। এর বাইরেও আমার দায়িত্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মনিটর করা। ব্রিগেডে আমার কন্ট্যাক্ট পয়েন্ট ছিল দু’টো, বিএম এবং ডিকিউ, বিএম হলো ব্রিগেড মেজর যার দায়িত্ব অপারেশনাল আর ডিকিউ হলো ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট এডজুট্যান্ট এন্ড কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল যার দায়িত্ব লজিস্টিক্স, জেলা প্রশাসনে এনডিসি’র কাজের মতো, জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ। বিএম হিসেবে পাই আমার দেখা সবচেয়ে স্মার্ট সেনা কর্মকর্তা মেজর ফারুক আশফাককে, তিনি পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ থেকে অবসরে যান। ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো (বিএটি)’র প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন, ২০১৭ সালে বিএটি সংলগ্ন রেললাইনে মারা যান। আত্মহত্যা? কে জানে!! এরপর বিএম হিসেবে আসেন মেজর ফখরুদ্দিন হায়দার যিনি ব্রিগেডিয়ার পদ থেকে অবসরে যান। এখন বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনে আছেন। ডিকিউ ছিলেন মেজর খালেদ আখতার, যিনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক অফিসে এবং এরপরে মেজর নজরুল। মেজর ফারুক ও মেজর খালেদের সঙ্গে তিনমাস কাজ করতে কোন অসুবিধা হয়নি।
প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ব্রিগেড মেস নাইটে আমিও আমন্ত্রিত থাকতাম সেখানে আড্ডা গল্পগুজব হতো, তাম্বুলা খেলা হতো আর কখনো অন্য কিছু। ব্রিগেড থেকে আমার দাপ্তরিক ব্যবহারের জন্য অন-ডিমান্ড একটি সাদা পিকআপ দেয়া হয়েছিল আর এসডিও অফিসে আমার ব্যবহারের জন্য ছিল একটা মিনিমোক, যে গাড়ী এখনকার প্রজন্মের কেউ দেখেনি। মেস নাইটে ব্রিগেড সদরসহ তিন ব্যাটালিয়নের সেনা কর্মকর্তাগণ থাকতেন। কখনো কখনো রাঙ্গামাটি বা চট্টগ্রাম ডিভিশনের ভিজিটিং কর্মকর্তাগণও থাকতেন। ফলে দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে মার্শাল’ল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সব সেনা কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। এই পরিচয় শুধু সেখানকার চাকরিকালেই নয়, বাকি চাকরি জীবনেও সহায়ক হয়েছে। প্রথম মেস নাইটেই তাম্বুলা (হাউজি) খেলায় ‘বিগিনার্স লাক’ হিসেবে আমি পুরস্কার পেয়ে যাই। রাতের খাবারের আগে মেসবয়রা ট্রেতে করে ক্লোরোকুইনসহ আরো কি একটা ওষুধ নিয়ে আসতো, প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে ট্যাবলেট খেয়েছি পরবর্তী তিন বছর ধরে প্রাণঘাতী সেরেব্রাল ম্যালেরিয়া ঠেকানোর জন্য।