জালাল আহমেদ
বদমেজাজী সেনা কমান্ডারের সমীহ পেয়েছিলেন দুই মেধাবী ইউএনও
আমি লক্ষ্য করলাম যে ব্রিগেড কমান্ডার কেবল দু’জন সিভিল অফিসারকেই সমীহ করে কথা বলছেন। এর কারণ লক্ষ্য করলাম তাঁরা কথা বলছেন সূত্রসহ, আইন বিধি বা বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করে। এ কারণেই তাঁরা এই সমীহটুকু আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। এটা ছিল একটা বাস্তব শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা। আমার বাকি জীবন তা কাজে দিয়েছে।
এসডিও সাহেব আমাকে পেয়ে একটু আশ্বস্ত হলেন, যদিও বাকি তিন থানা উপজেলা হওয়াতে এক থানার মহকুমা, হোক, মহকুমাতো! আর কোন অফিসার না থাকায় সব কাজের ভারও পড়লো আমার উপরে। ঐদিন সকালেই এক বিদেশিনী এসে হাজির, পার্বত্য এলাকায় বিদেশীদের প্রবেশে বিধিনিষেধ ছিল। তিনি বিশ্বখাদ্য কর্মসূচী বা এমন কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এসেছিলেন। আমার উপর দায়িত্ব পড়লো তাঁর সঙ্গে থাকার। তিনি দিঘীনালা রোডে কৃষি খামার দেখলেন সময় নিয়ে, দু’একটি ফসলী জমি দেখলেন এবং জুম চাষ সম্পর্কে ধারণা নিলেন। তাঁর গাড়ির বুট ভর্তি ছিল খাবার ও পানীয়, কিন্তু আমাদের কিছুই তিনি খেলেন না, দুপুরের পর চলে গেলেন। বিকেলে অফিসে বসে একটু কাজ বুঝে নিলাম। এরমাঝে জানা গেলো যে পরদিন নর্দার্ন রিজিওন কো-অরডিনেশন কনফারেন্স হবে। ২০৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড এর অপারেশনাল আওতাধীন এলাকা নিয়ে এই বৈঠক। বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ রাঙ্গামাটি এবং চট্টগ্রাম থেকে আসতে শুরু করেছেন। আমি বিকেলের মধ্যেই সিএইচটিডিবি’র রেস্টহাউজ ছেড়ে অতিরিক্ত মহকুমা প্রশাসকের পাশের বাংলোতে এসে আস্তানা গাড়লাম।
তখন সামরিক শাসন, দেশের কার্যকর ক্ষমতা চীফ মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর (সিএমএলএ) এর কাছে। তাঁর নীচে ৫ জোনাল মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর (জেডএমএলএ) এবং তাঁর নীচে ১৯ সাব-জোনাল মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর (এসজেডএমএলএ)। এছাড়া, ২১ জেলায় ছিলেন ডিএমএলএ, ডিস্ট্রিক্ট মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর। খাগড়াছড়ির সাব-জোন রাঙ্গামাটি জেলা সদরে কিন্তু মহকুমা সদরে যেহেতু একজন ব্রিগেড কমান্ডার বসেন তিনি এই সুযোগ ছাড়বেন কেন? খাগড়াছড়ি, রামগড় ও বাঘাইছড়ি এলাকা ছিল এই ব্রিগেডের অপারেশনাল রিজিওন তাই এই নামে এক কনফারেন্স। এসডিও সাহেব আমাকে বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে রেজুলেশন লিখতে বললেন। সিএইচটিডিবি রেস্টহাউজে কনফারেন্স হবে, বিভিন্ন সংস্থার জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রাম থেকে এসে সকালের মধ্যেই সভায় যোগ দিয়েছেন। আমি হেড অফ দ্য টেবল এর কাছেই একটা ছোট টেবিলে বসলাম। উল্টোদিকে বসলেন ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম, ছোট খাট দেখতে, খুলনার মানুষ। তখন রাঙ্গামাটি যাতায়াতের হ্যাপা ছিল অনেক। ফটিকছড়ি- হাটহাজারী হয়ে রাঙ্গামাটি যেতে হতো যা ছিল সময়সাপেক্ষ। লেকের পথে যাওয়া যেতো, কমলছড়ি পর্যন্ত ৮ মাইল গাড়িতে গিয়ে বোটে চড়ে চেংগী হয়ে লেক দিয়ে রাঙ্গামাটি। বর্ষায় খাগড়াছড়ি বাজার থেকেও বোটে ওঠা যেতো কিন্তু জলপথ নিরাপদ ছিল না। শীতকালে মহালছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি যাবার একটা রাস্তা ছিল, বাস্তবে সে রাস্তা কেউ ব্যবহার করতো না। ২০০৯ সালে একবার সস্ত্রীক খাগড়াছড়ি গেলে ফেরার দিন আকস্মিক সিদ্ধান্তে এই রাস্তা ধরে রাঙ্গামাটি যাই। ঐদিন ঐ রাস্তার খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি অংশকে বাংলাদেশের নির্জনতম ও সুন্দরতম রাস্তা মনে হচ্ছিল। তাহলে ১৯৮৩ তে ওই কাঁচা রাস্তা কেমন ছিল তাই ভাবছি।
ব্রিগেড কমান্ডারের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়, পরে জানি যে তিনি অন্যতম বদমেজাজী সেনা কমান্ডারদের একজন। সভায় খাগড়াছড়ি রিজিওন এর জোন কমান্ডার/ব্যাটালিয়ন কমান্ডার, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ব্যাটালিয়ন আনসার ও অধুনালুপ্ত বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) এর কমান্ডিং অফিসারগণ উপস্থিত ছিলেন। দিঘীনালাতে ১ ইস্টবেঙ্গল এর সিও ছিলেন লেঃ কর্ণেল আব্দুর রব বিপি, খাগড়াছড়ি ৩৬ ইস্ট বেঙ্গল এর সিও ছিলেন লেঃ কর্ণেল আরেফুর রহমান, গুইমারা ৪ ইস্ট বেঙ্গল এর সিও ছিলেন লেঃ কর্ণেল নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বিপি। এপিবিএন এর সিও ছিলেন এসপি কুতুবুর রহমান, খাগড়াছড়ি ২৪ রাইফেলস এর সিও ছিলেন মেজর সোলায়মান, রামগড় ২২ রাইফেলস এর সিও এর নাম এই মুহূর্তে স্মরণে আসছে না। আমি লক্ষ্য করলাম যে ব্রিগেড কমান্ডার কেবল দু’জন সিভিল অফিসারকেই সমীহ করে কথা বলছেন। একজন হলেন দিঘীনালার ইউএনও মোঃ তাজুল ইসলাম অপরজন পানছড়ির ইউএনও সাদা চুলের মোঃ রফিকউদ্দিন মোল্লা। এর কারণ লক্ষ্য করলাম যে যখনই তাঁরা কথা বলছেন, জিজ্ঞাসিত হয়ে বা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে, তাঁরা কথা বলছেন সূত্রসহ, আইন বিধি বা বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করে। এ কারণেই তাঁরা এই সমীহটুকু আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। আমার মতো একজন শিক্ষানবীশ কর্মকর্তার জন্য এটা ছিল একটা বাস্তব শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা। আমার বাকি জীবন তা কাজে দিয়েছে। এটা হয়তো সহজ ছিল না কিন্তু অভ্যাস করে নিলে সহজ হয়।
কনফারেন্সের আরেকটা লাভ হলো এই রিজিওন এর সামরিক-বেসামরিক সব কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো। ঐদিন বিকেলেই সিভিল লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে আমার অতিরিক্ত দায়িত্বের আদেশ হলো। আর রেস্টহাউজ ছেড়ে অতিরিক্ত মহকুমা প্রশাসকের বাংলো’র পাশের বাংলোতে আস্তানা গাড়লাম। বেডিং আমার সংগেই ছিল, একটা চৌকিও পাওয়া গেলো। সন্ধ্যায় এসডিও সাহেবের বাসায় গেলাম সেই সরু রাস্তা ধরে। তাঁর চার মেয়ে ও দুই ছেলে, তাদের কেউ কেউ বাসাতেই ছিল। বড় মেয়ে একাডেমিকালী আমার ব্যাচমেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, পরে ১৯৮৫ ব্যাচে সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছিল। বড় ছেলেও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়ে পড়তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, তৃতীয় জনও পরে সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছিল। এই জঙ্গলে পাহাড়ি শহরে অনেক সন্ধ্যাই এসডিও সাহেবের বাসায় কাটিয়েছি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন মাতৃময়ী এবং আমার জন্য ভালো নাস্তা বরাদ্দ ছিল প্রতিদিন।
ঐদিন রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখা গেলো যে জানালা কাঁচের এবং শান্তিবাহিনী অধ্যুষিত এই মহকুমায় বেপর্দা রাত কাটাতে হবে কারণ বাইরে থেকে তাকালেই আমাকে দেখা যাচ্ছে! আবার বিছানায় শুয়ে সিলিং ঘেঁষা দেয়ালে তাকাতেই চমকে উঠলাম, কি এটা? টিকটিকি কিন্তু কুমিরের বাচ্চার সাইজ!