হবিগঞ্জে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার
প্রস্তাবিত প্রকল্পে চুনারুঘাট থেকে হবিগঞ্জ শহর পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাধের প্রতি ১ কিলোমিটার পর পর নদীর উভয় পার্শ্বে ফ্ল্যাসিং ইনলেট বসানো হবে ॥ ৬০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাধ ছাড়াও ভাটি এলাকার ৬০ কিলোমিটার ডুবন্ত বাধ সংস্কার করা হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেছেন- এ বছরেই শুরু হবে হবিগঞ্জের খোয়াই নদী প্রকল্পের ২হাজার কোটি টাকার কাজ। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির প্রি-একনেক হয়েছে। শীঘ্রই একনেকের বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন পাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে খোয়াই নদীর বন্যার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে হবিগঞ্জ শহর। অপরদিকে রক্ষা পাবে ৪৭ হাজার ৫শ হেক্টর জমির ফসল। নদী দিয়ে প্রবাহিত পলি সংরক্ষণ করে এসকল জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করা হবে। নদীর বাধ হবে বয়স্ক লোকদের বিনোদনের কেন্দ্র। গড়ে উঠবে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা।
গতকাল বুধবার বিকেলে তিনি হবিগঞ্জ শহরের মাছুলিয়া এলাকায় খোয়াই নদীর বাধে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বৃক্ষরোপন কর্মসূচির উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে সরকার ১ কোটি গাছের চারা রোপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মাঝে আমাদের মন্ত্রণালয় করবে ১০ লক্ষ গাছ। দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিবেশের উপযোগী গাছ লাগানো হচ্ছে। হবিগঞ্জের নদীর বাধে রোপন করা হবে কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়া, সোনালু, শিমুল, পলাশ, জারুল, হিজল ও করচসহ বিভিন্ন ফুল এবং ঔষধি গাছ। এছাড়াও পাখির খাবারের জন্য জাম, ডুমুর, বটসহ বিভিন্ন বৃক্ষ রোপন করা হবে।
বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম, হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা ও আইসিটি উম্মে ইসরাত, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন রুবেল।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, খোয়াই নদীর মাছুলিয়া থেকে চৌধুরী বাজার পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আমরা বৃক্ষ রোপন করব। এর ফলে সেখানকার পরিবেশ হবে মনোরম এবং পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, খোয়াই নদী একটি পলিবাহিত নদী। বাংলাদেশ ও ভারত দিয়ে প্রবাহিত এই নদীতে বর্ষকালে পাহাড়ী ঢল আর ভারত কর্তৃক বাধ খুলে দেয়ার ফলে নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে ভয়ংকর রূপ ধারন করে। হুমকিতে পড়ে যায় শহর প্রতিরক্ষা বাধ। প্রতি বছরই কিছু কিছু কাজ হলেও স্থায়ী কোন সমাধান হচ্ছে না। তাই এবার বৃহৎ আকারে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে চুনারুঘাট থেকে হবিগঞ্জ শহর পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাধের প্রতি ১ কিলোমিটার পর পর নদীর উভয় পার্শ্বে ফ্ল্যাসিং ইনলেট বসানো হবে। যখন নদীতে পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে তখন ১২০টি ফ্ল্যাসিং ইনলেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি প্রকল্পভুক্ত জমিতে বের করে দেয়া হবে। এর জন্য প্রতিটি ইনলেটের সাথে সংযোগ খাল খনন ও সংস্কার করা হবে। এই ইনলেটগুলো দিয়ে যখন পানি বের করা হবে তখন ১ ফুট পানি অপসারণ করলে নদীর ২ থেকে আড়াই মিটার পানি কমে যাবে। এতে করে পানির হুমকি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আর যে পানি অপসারণ করা হবে তার সাথে থাকবে পলি। এই পলি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। এছাড়াও একটি স্পিল ওয়ে নির্মাণ করা হবে। যদি পানি ফ্লাসিং ইনলেট দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তখন স্পিল ওয়ে দিয়ে অতিরিক্ত পানি গুঙ্গিয়াজুড়ি হাওরে প্রবেশ করানো হবে। পানি প্রবাহের জন্য যাতে লোকালয়ের কোন ক্ষতি না হয় তার জন্য সরবরাহ খালের বাধ টেকসই করা হবে।
৬০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাধ ছাড়াও ভাটি এলাকার ৬০ কিলোমিটার ডুবন্ত বাধও সংস্কার করা হবে। ভাঙ্গন প্রবণ সাড়ে ১৫ কিলোমিটার নদীর তীর ব্লক দিয়ে সংরক্ষণ করা হবে। নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকায় চলবে ড্রেজিং কাজ। ড্রেজিং করার পর যে মাটি উত্তোলন হবে তা দিয়ে বাধের দুইদিক মজবুত করা হবে। বর্তমানে বাধের প্রস্ত আছে ১৪ ফুট। ড্রেজিং এর পর তা করা হবে ২০ ফুট। বাধকে করা হবে রিক্রিয়েশন এলাকা। প্রবীন লোকজন যাতে হাটাচলা করতে পারে তার জন্য প্রতি ৩শ মিটার পর পর থাকবে বসার স্থান। তবে রাস্তার মাঝে নয় একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসানো হবে এই সকল ব্রেঞ্চ। বাধের উপরভাগ মজবুত করতে পাকা করণ করা হবে। এতে করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিদর্শন কাজে সহযে যাতায়াত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিকল্প সড়ক হিসাবে লোকজন বাধের উপর দিয়ে চলাচল করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, খোয়াই নদীর ধ্বংস লীলা ও এর বিরূপ প্রভাব থেকে নদীর দু’তীরের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল এবং জানমাল রক্ষায় ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সরকার একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে। ১৯৭৩ সালে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান প্রকল্প এলাকায় জরিপ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। তখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ খোয়াই নদীর সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ৩৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়। পরিকল্পনায় খোয়াই নদীর উভয় তীরে ৭৮ মাইল প্রতিরক্ষা বাঁধ, নদীর দু’তীর রক্ষায় ছয়টি স্থানে প্রতিরক্ষার দেয়াল নির্মাণ, ছয়টি স্থানে নদীর বাঁধ কেটে সোজা করা এবং আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ, আখাউড়া-সিলেট রেলওয়ে সেকশনের শায়েস্তাগঞ্জে খোয়াই নদীর উপর রেল সেতু পুনঃনির্মাণ, দু’টি পাইপ নিগর্মন প্রনালী ও পাম্প স্টেশন স্থাপন, ৬৫ মাইল জুুড়ে পানি নিগর্মণ ব্যবস্থা, নদীর গতি পরিবর্তন প্যানিং পান্ট এবং ৩৭ মাইল সেচ প্রয়ঃপ্রণালী অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বন্যার কবল থেকে ফসলী জমি ও হবিগঞ্জ শহর রক্ষা এবং সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা ছিল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রথম পর্যায়ে ২৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ের পরও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। পরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ১৯৯৫-৯৬ সালে ৭২ কোটি টাকা একটি সংশোধিত স্কীম গ্রহণ করা হয়। তখন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ মিলে ১৮ কোটি টাকা। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তা আবার বৃদ্ধি করে উন্নীত করা হয় ৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকায়। ২০০২-০৩ অর্থ বছরে প্রকল্প ব্যয় পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ২য় পর্যায়ের কাজে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ব্যয় করা হয় ৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কথা ছিল ২০০৬ সালের মধ্যে প্রকল্পের সমুদয় কাজ শেষ হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে নদীর উভয় পাশে ৯৩ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ৩৬ কিলোমিটার ডুবন্ত (সাব-মার্জেবল) বাঁধসহ ৮টি স্থানে নদীর বাঁক কেটে সোজা করা, দু’টি স্লুইস গেট নির্মাণ, ২৮টি সেচ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং স্থানে স্থানে পাথর ও ব্লক দিয়ে বাধ সংরক্ষণ কাজ।