বরফের রাজ্য সিকিম ভ্রমণ ৪

ডাঃ শেখ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ

যাই হোক লাচুং এর পথে কিছুক্ষণ বিরতির পর আমরা আবার সবাই যাত্রা শুরু করলাম। তাশি সাহেবের কাছ থেকে জেনে নিলাম লাচুং এ পৌঁছাইতে আমাদের আরও ১ ঘণ্টা লাগবে। গাড়ী চলছে মাধারি গতিতে। আসলে মাজারি গতিতে গাড়ি না চালিয়ে উপায় নেই কারণ রাস্তা খুবই সরু আর মাঝারি গতিতে চললে আরেকটি লাভ আছে সেটা হচ্ছে আশেপাশের অপরুপ সৌন্দর্য্য। দুইই চোখ ভরে আমি, আমার স্ত্রী, নিবিড় ভাই, আপন ভাবী আর আমার দুই ছেলে আতিফ এবং নাসিফ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। হয়তো সবাই ভাবছে আবার কবে আসব অথবা আদৌ আসা হবে কিনা তাই আমরা সবাই ভালো করে সব দেখে নিচ্ছি।
হঠাৎ আমার স্ত্রী আমাকে বললেন “ডাঃ আব্দুল্লাহ তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, তুমি জোর করে এখানে নিয়ে না আসলে হয়তো এই সৌন্দর্য্য দেখতে পারতাম না” আমি শুধু মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম এই সিকিম আসা নিয়ে কত কিই না হলো।
পথে চলতে চলতে হঠাৎ নজরে এলো পাহাড়ের ভিতর গর্ত করে ক্যানেলের মতো করে রাস্তা বানানো হয়েছে যার নাম দেয়া হয়েছে THENG CANAL..পুরো ক্যানালটি পাহাড়ের নিচ অংশ ছিদ্র করে বানানো।
শীতের তীব্রতা মনে হচ্ছে হঠাৎ করে আরও বেড়ে গেল। হাতে গ্লাভস, শরীরে মোটা জ্যাকেট থাকার পরেও মনে হচ্ছে শীত একেবারে হাড্ডিতে আঘাত করছে। এর আগে সিমলা, মানালি গিয়েছি কিন্তু এতো শীত জীবনে কখনও অনুভূত হয়নি। রাস্তার মানুষদের ভালো করে খেয়াল করলাম। তারা শুধুমাত্র একটি সোয়েটার আর পায়ে প্লাস্টিক এর বুট পরে দিব্যি হেটে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ করেই তাশি সাহেব গাড়ি থামালেন। একটু উকি মেরে দেখলাম দোতলা বাড়ির সামনে আমরা আছি। বাড়ির নাম THE PARK PALACE..পরে বুঝতে পারলাম এটাই আমাদের হোটেল আর আমরা পৌঁছে গেছি উত্তর সিকিমের একটি গ্রামে যে গ্রামের নাম লাচূং (LACHUNG)!!!
যখন লাচূং পৌঁছলাম তখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল। হোটেল পার্ক প্যালেসে চেক ইন এর পর বুঝতে পারলাম এই হোটেলে আমরা ছয়জন ছাড়া আর কেউ নেই!!
শীতের তীব্রতা দেখে রিসিপশনে বলে দিলাম যেন রুম হিটার এখুনি দিয়ে দেয়া হয়। তাপমাত্রা তখন -৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রুমে বসে সবাই ভাবছি ফ্রেশ হব কি-না কারণ আমাদের অসম্ভব শীত লাগছে। পানি গরম করলেও ঠান্ডা হতে এক মিনিটও লাগছে না। সবাই কোনোরকম কষ্ট করে ফ্রেশ হয়ে কিছু হাল্কা খাবারের অর্ডার করলাম।
লাচুং চায়না বর্ডারের কাছাকাছি অবস্থিত উত্তর সিকিমের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। এখানকার অধিবাসীরা সাধারণত দরিদ্র। এরা পর্যটকদের উপরেই নির্ভরশীল। মোবাইল নেটওয়ার্ক অতোটা ভালো নয় এরপরেও মা’কে ফোন করে বলতে পারলাম যে আমরা ঠিকমতো লাচুং পৌঁছেছি কারণ আমার মা আমাদের এই যাত্রার ঘোর বিরোধী ছিলেন!!! ঘোর বিরোধী হবার কারণ ছিল ভারতের রাজনীতি অস্থিতিশীলতা আর শীতকালীন আবহাওয়া!!!
ইতোমধ্যে আমাদের অর্ডার করা নুডলস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এসে হাজির কিন্তু মুখে নেবার পর সবার অবস্থা বেগতিক। এতো পরিমাণ লবণ দিয়ে কোনো খাবার বানানো হয় সেটা আমাদের আগে জানা ছিল না। কোনো রকম খেয়ে আমরা আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করলাম। রাত ৯টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম। রাত ১০ টার দিকে আতিফ আমাকে ডেকে বলল যে তার খুব বোরিং লাগছে সে বাইরে যেতে চায়। আমার স্ত্রী রাজি না হওয়া সত্ত্বেও আমি আর আতিফ রাতে বের হলাম …পরনে আমার দুইটা সোয়েটারের উপর মোটা জ্যাকেট সাথে ডাবল প্যান্ট…এরপর পায়ে ডাবল বার্সিলোনার লম্বা মোজা আর মাথায় গোল টুপি তো আছেই এরপরেও মনে হচ্ছে শীত একেবারে শরীরের ভেতরে আঘাত করছে!!!
রাস্তায় আমি আর আমার বড় ছেলের সঙ্গী ৪/৫টা কুকুর। আর কোনও জনমানবের চিহ্ন নেই। কেমন জানি লাগছে!! আতিফকে বললাম “চল আব্বু রুমে ফিরে যাই”। আতিফের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা রুমে ফিরে আসি। দেখলাম আমার স্ত্রী সজাগ এবং পরবর্তী গন্তব্যের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেবার চেষ্টা করছে কারণ এরপরে আমাদের গন্তব্যস্থল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ হাজার ফুট উপরে মাউন্ট কাটাও (Mt.KATAO).
খুব সকালেই রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়লেন যদিও আমি এবং আমার পরিবারের সবাই জেগেই ছিলাম। দরজা খুলে দেখি নিবিড় ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই বললেন রুমের জানালা খুলতে। আমি মনে মনে ভাবলাম বলে কি??? এই ঠান্ডায় রুমের জানালা খুলতে বলছে কেন?? আর কিছু না ভেবে রুমের জানালা খুলে মনে হলো কোনো জান্নাতে আছি। এ যে অপরূপ দৃশ্য!! গতকালই যেখানে দেখলাম শুধু পাহাড় আর মেঘ আজ সেখানেই দেখি বরফ আচ্ছাদিত সাদা পাহাড়। হাল্কা সূর্যের আলোয় বরফগুলি যেন চিক চিক করছে। এক নিমিষেই ঠান্ডা আর কষ্টকর যাত্রার কথা ভুলে গেলাম। আমার স্ত্রী আর ছেলেদের আনন্দ দেখে মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম হাঁটতে বের হব। সবাইকে বললাম রেডি হবার জন্য। ১০ মিনিটের মধ্যে সবাই রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম।
যখন হাঁটতে বের হয়েছি তখন প্রায় সকাল ৬টা৪৫ মিনিট। মুগ্ধ চোখে দেখছি চারপাশ। কিছু ছবি তুলে ফেললাম। গ্লাভস পড়ে ঠিক মতো ক্যামেরা ধরা যায় না আবার গ্লাভস খুললেও ঠান্ডায় হাতের আঙ্গুল অবশ হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে আতিফ এবং নাসিফ রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বরফস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে। আমার স্ত্রীকেও দেখলাম বরফ ছুয়ে দেখছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলকে দেখলাম হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার চলে গেল। পরে বুঝতে পারলাম আমাদের খুব কাছেই অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। ইতোমধ্যে ড্রাইভার তাশি সাহেবের মোবাইল কল এলো। বলল আমরা কাটাও ভ্রমনের জন্য প্রস্তুত কি-না।
দ্রুত হোটেলে ফিরে এলাম। ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম আমার স্ত্রীর একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নেবার পর আমার স্ত্রী স্বাভাবিক হলেন। বুঝতে পারলাম এটা উচ্চতাজনিত শ্বাসকষ্ট। ছেলেদের দিকে খেয়াল রাখছি কিন্তু তারা ঠিক আছে বুঝতে পারলাম।