এতিমদের সাথে ইফতারে শরিক হয়ে নিজের ভেতরটা বেশ আবেগী হয়ে ওঠে
আতাউর রহমান কানন
২০ সেপ্টেম্বর ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকালে যথারীতি অফিসে যাই। অফিসের কাজকর্মে একরকম ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার পারিবারিক প্রয়োজনে সাপ্তাহিক বন্ধ ঢাকায় কাটানোরা জন্য এ সপ্তাহের শুরুতে একটি ছুটির দরখাস্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করেছিলাম। আজ দুপুরে জানতে পারি, মান্যবর বিভাগীয় কমিশনার আজিজ হাসানের অসহযোগিতার কারণে তা নামঞ্জুর হয়েছে। আমার ঘনিষ্ঠ অগ্রজ সহকর্মী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) জাহিদ হোসেনকে টেলিফান করলে তিনি ছুটি নামঞ্জুর কারণটি জানান।
তখন আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, এর আগে ভাতিজি বিবাহ উপলক্ষ্যে তাঁর এখতিয়ারধীন ছুটি নিয়ে তাঁর সাথে যে ঘটনা হয়েছিল, এবার তার প্রতিদান বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজের ভেতরে জেগে ওঠা রাগে মাটিচাপা দিলাম। অফিস শেষে সাড়ে তিনটায় বাসায় ফিরে আসি। রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে অভ্যাসবশত ডায়েরি নিয়ে বসলাম। দিনের ঘটনাবলি ঘটা করেই লিখলাম।
আজ আমার জেলা প্রশাসক হিসেবে এক বছর পূর্তি দিবস। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল! আমার ঘনিষ্ঠজনের কারো মনে ছিল কিনা জানি না, তবে আমার নিজেরও মনে ছিল না। ডায়েরি লিখতে লিখতেই হঠাৎ মনে হলো। পদের বর্ষপূর্তি আহামরি কিছু না, তবে ছুটি নামঞ্জুরের ব্যথাটা মাঝে মাঝে গলার কাঁটা হয়ে খচ্খচিয়ে উঠতে থাকে।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭, সোমবার। গতকাল আমার অসুস্থ শাশুড়িকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। আজ বিকেলের দিকে ঢাকায় গিয়ে তাঁকে দেখে আজই ফিরে আসব স্থির করলাম। অতীত বিবেচনায় বিভাগীয় কমিশনারকে তোয়াজ করতে মন আর সায় দিলো না। আমিও মনের বিরুদ্ধে গেলাম না, যা হয় হোক।
সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ কাজকর্ম করি। এরপর ১১টায় মাধবপুর উপজেলায় পূর্বনির্ধারিত দুটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাই। পরিদর্শন শেষে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ১০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুকূলে সরকারি বরাদ্দকৃত ১ লাখ টাকার চেক বিতরণ করি। সেখান থেকে সাড়ে ১২টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। তিনটায় ঢাকার বাসায় পৌঁছে লাঞ্চ করে ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে অসুস্থ শাশুড়িকে দেখি। চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়ে রাত ৮টায় ঢাকা ত্যাগ করে ১১টায় হবিগঞ্জ ফিরে আসি।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় বানিয়াচং উপজেলার উদ্দেশে রওনা করি। সেখানে সকাল ১০টায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে আজ আমন ধানের চারা বিতরণ করতে আসবেন জিওসি মেজর জেনারেল আবদুল হাফিজ। হবিগঞ্জের সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির জেলা ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় ইউএনও’র সাথে সমন্বয় করে বানিয়াচং এলআর হাইস্কুলের মাঠে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সকাল ১০টায় জেওসি সাহেব আসেন এবং আগে থেকেই বাছাইকৃত ১০০জন কৃষককে তিনি ধানের চারা বিতরণ করে সাড়ে ১১টায় চলে যান। এরপর আমি বানিয়াচং উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বন্যাদুর্গত ২০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করি। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির হবিগঞ্জ শাখা থেকে এই ত্রাণ বিতরণের আয়োজন করা হয়। আমি সাড়ে ১২টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।
আজ শহরের রাজনগর ইসলমিয়া এতিমখানায় আয়োজিত ইফতারে যোগদান করি। এতিমখানার অধিবাসীদের সাথে ইফতার করে আমার ভেতরে একটি অন্যরকম মায়াবী অনুভূতি কাজ করল।
পরের দিন সকালে টেলিফানে জানলাম যে, আমার শাশুড়ির বাইপাস অপারেশনের দরকার হয়নি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোমেনুজ্জামান হার্টে রিং পড়িয়েছেন।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭, শুক্রবার। আজ ১৫ রমজান। অস্থায়ী কোর্ট মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করি। অতঃপর মুসল্লিদের নিয়ে এ বিশেষ দিনে ৪তলাবিশিষ্ট নতুন কোর্ট মসজিদ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭, রবিবার। সকাল ৯টায় সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের উদ্দেশে রওনা করি। সেখানে পৌঁছে বিভাগীয় আইনশৃঙ্খলা ও চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় যোগদান করি। বরাবরের ন্যায় এবারও সভাসমূহের সভাপতি মাননীয় কমিশনার সভায় লিড নিয়ে ইংরেজি ভাষায় সভা পরিচালনা করেন। এতে সভায় উপস্থিত সদস্যদের বেশি কথা বলার সুবিধা না থাকায় সভাসমূহ টাইমলি শেষ হয়। অবশ্য সভার কার্যপত্র-কার্যবিরণী সব বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুসারে বাংলায় সুলিখিত। আমাদের বর্তমান বিভাগীয় কমিশনার বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হয়েও ইংরেজি কথনে বেশ অনর্গল। তিনি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তাঁর কারণে আমরা ডিসিরাও ইংরেজি কথন প্রাকটিস করতে লাগলাম।
সভা শেষে বিকেল ৪টায় সিলেট থেকে হবিগঞ্জ ফিরে আসি। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে জেলা জজশিপের ইফতার অনুষ্ঠানে যোগদান করি। উকিলবারের সদস্যগণই মূলত দাওয়াতি। ইফতার শেষে সন্ধ্যা ৭টায় বাসায় ফিরে আসি।
পরদিন হবিগঞ্জ শিশু সদন কেন্দ্রে এতিমদের সৌজন্যে মাইনর টাইগার্স এর পক্ষ থেকে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সেখানে বিজ্ঞ জেলা জজ, এসপি, কর্নেল ও আমি দাওয়াতি ছিলাম। এ ছাড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি-সেক্রেটারিও ছিলেন। এতিমদের জন্য এ আয়োজন বেশ সুন্দর ও ছিমছাম ছিল। তাদের সাথে ইফতারে শরিক হওয়ায় নিজের ভেতরটা বেশ আবেগী হয়ে ওঠে। নিজেকেও ওদের একজন বলে মনে হতে থাকে।
২ অক্টোবর ২০০৭, মঙ্গলবার। আজ বাইরে কোনো প্রোগ্রাম না থাকায় ৯-৩টা অফিস করে বাসায় ফিরে আসি। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আজ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে জেলার সকল অফিস প্রধান, ইউএনও, বাগান ম্যানেজার, উকিলবার ও প্রেসক্লাবের সভাপতি-সেক্রেটারি এবং জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যথাসময়ে আমন্ত্রিত অতিথিরা আসেন এবং সুষ্ঠুভাবে মাহফিল শেষ হয়।
রোজার শেষ দিকে বিভিন্ন দফতর-সংস্থায় ইফতার মাহফিলের একরকম ধুম পড়ে যায়। আর জেলা প্রশাসক হিসেবে আমাকেও প্রায় সবগুলোতে যোগদান করতে হয়। আমার ডায়েরিতে আরও বেশ কয়েকটি দাওয়াতের এন্ট্রি রয়েছে। এরমধ্যে জেলা আইনজীবী সমিতি, হবিগঞ্জ আহছানিয়া মিশন, হবিগঞ্জ পৌরসভা, পুলিশ লাইন প্রভৃতি।
৫ অক্টোবর ২০০৭, শুক্রবার। সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। রমজান মাসের ছুটির দিনে বাসায় তেমন একটা ভিজিটর আসেন না। আমারও সময় ভালো কাটে। তবে আজ সকালে টেনিস ক্লাবের সেক্রেটারি বাছিত চৌধুরী বাসায় এসে টেনিস মাঠে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। রমজান মাসে টেনিস খেলা বন্ধ থাকায় মাঠের সংস্কার কাজ চলছে। সে কাজ আমাকে দেখতে যেতে অনুরোধ করেন। আমি ১১টার দিকে তাঁর সাথে মাঠে গেলাম। বেশ বড় ধরনের সংস্কার কাজ, যা মাঠ পুননির্মাণ। ব্যয় প্রাক্কলিত বাজেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে ক্লাব সেক্রেটারি জানান। কমিটির আরও লোকজন ছিলেন। কী আর করা! যা লাগে লাগুক বলে উপস্থিত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়ে বাসায় ফিরে আসি।
৯ অক্টোবর ২০০৭, মঙ্গলবার। আজ সকাল ১১টায় কিবরিয়া পৌর মিলনায়তনে যাই। সেখানে নব প্রতিষ্ঠিত আলোর সন্ধানে শিক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রথম কার্যক্রম ‘আজান ও ক্বিরাত প্রতিযোগিতা’র উদ্বোধন করে আমি অফিসে ফিরে আসি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে আরবি শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত কমিটি এ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করে। বিকেল সাড়ে তিনটায় মিলনায়তনে গিয়ে সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির, এসপি রফিক ও অন্যান্য অতিথিদের উপস্থিতিতে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি। সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। চলবে…