স্টাফ রিপোর্টার ॥ বানিয়াচং উপজেলার বক্তারপুর আবুল খায়ের উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের বেতন, বিভিন্ন ফি, স্কুলের বিভিন্ন বরাদ্দসহ অনিয়ম হয়েছে সর্বক্ষেত্রে। ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলায় ফলাফল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এক সময়ের স্বনামধন্য এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এ ব্যাপারে মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশন, বক্তারপুর আবুল খায়ের উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সভাপতিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় ২ বছর ধরে বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের আশঙ্কায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। অধ্যক্ষ (সাময়িক বরখাস্তকৃত) মোঃ কামাল হোসেন বলেন, প্রতিষ্ঠানটি আমার দীর্ঘদিনের গড়া। আমি যোগদানের পর থেকে প্রথমেই ফলাফল, শিক্ষার মানোন্নয়ন, উন্নয়ন, পাঠদানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির প্রতি জোর দেই। সফলতাও পাই। এক বছরের মধ্যেই ফলাফলে ব্যাপক সাফল্য পায় প্রতিষ্ঠানটি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বৃদ্দি পায়। পূর্ববর্তী সময়ের অডিট প্রতিবেদনে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি নামে নামকরণ করা হয়নি উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও অবৈধভাবে যোগদান, অনুমোদন ছাড়াই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ হামিদুর রহমানের নির্দেশে একজন সহকারী শিক্ষক ও ২ জন প্রভাষক এনটিআরসিতে নিশ্চায়ন করা হয়। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকা। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলার কারণে প্রতিষ্ঠানের ভূমি সমস্যা সহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখিন হয়। ২০২০ সালের ২ মে তারিখে যোগদানকৃত প্রধান শিক্ষক মোঃ কামাল হোসেন গভর্ণিংবডি ও এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেন। এক বছরের মধ্যেই ফলাফলে ব্যাপক সাফল্য পায় প্রতিষ্ঠানটি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বৃদ্দি পায়। একই সাথে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বরাদ্দ ফেরত চলে যায়। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশের প্রেক্ষিতে এডহক কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর ডাচ্ বাংলা ব্যাংক হবিগঞ্জে শিক্ষার্থীদের সেশন ফিসহ বেতন, রেজিস্ট্রেশন ফি, ফরম ফিলাপ ফি, মোবাইল ব্যাংকিং (রকেট) এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করার চুক্তি সম্পাদন হয়। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি ও শিক্ষক-কর্মচারী আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তা বাস্তবায় করা সম্ভব হয়নি। অডিট রিপোর্টসহ বিভিন্ন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সেশন ফি, শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি, মূল্যায়ন ফিসহ বিভিন্ন খাত থেকে ১ কোটি ২৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪শ’ টাকা আদায়ের কথা ছিল। কিন্তু আদায় হয় ৬৭ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৭ টাকা। অনাদায়ী দেখানো হয় ৬২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৫৩ টাকা। এ সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির প্রশংসাপত্র বাবদ আদায় হয় প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু উক্ত টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়নি। জেএসসি ফরম পূরণ বাবদ উল্লেখিত ৫ বছরে আদায় হওয়ার কথা ছিল ৮ লাখ ৬২ হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু আদায় হয় ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৩১০ টাকা। অনাদায়ী দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯০ টাকা। এসএসসিতে আদায় হওয়ার কথা ছিল ৫২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। কিন্তু আদায় হয় ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা। অনাদায়ী দেখানো হয় ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা। প্রশংসাপত্র, মার্কশীট ও ট্রান্সক্রিপ্ট বাবদ আদায়যোগ্য ছিল ৬৫ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু অনাদায়ী দেখানো হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। ২০২০ সালে বিভিন্ন শ্রেণিতে এসাইনমেন্ট ফি ৪ লাখ ৫২ হাজার ১৬০ টাকা আদায়যোগ্য ছিল। কিন্তু অনাদায়ী দেখানো হয় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৪ টাকা। রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৫ বছরে আদায়যোগ্য দেখানো হয় ১২ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। আনাদায়ী দেখানো হয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫০ টাকা। বিদ্যালয় গভর্ণিং বডি ও শিক্ষকদের মিটিংয়ে ছাড় দিয়ে ২০২১ সালে আদায় হওয়ার কথা ছিল প্রায় ৫৯ লাখ টাকা। আনাদায়ী থাকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। তবে এসব টাকা কেন অনাদায়ী রয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা কোথাও উল্লেখ নেই। এ নিয়ে শিক্ষকদের বিরোধ দেখা দেয়। অধ্যক্ষ (সাময়িক বরখাস্তকৃত) মোঃ কামাল হোসেনের অভিযোগ, টাকা আদায়ে জোর দিলেই তাকে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠে শিক্ষক ও গভর্ণিং বডির সভাপতিসহ একটি অংশ। এইচএসসির ফরম পূরণের ১৯ হাজার ৩০০ টাকা সিলেট শিক্ষাবোর্ড থেকে ২০২১ সালে চেকের মাধ্যমে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু উক্ত চেক বিদ্যালয়ের হিসাবে জমা দেয়া হয়নি।
এদিকে বিদ্যালয়ের পাঠদানে মনোযোগ না দিয়ে শিক্ষকরা দলাদলিতে লিপ্ত হন। এ অবস্থায় অধ্যক্ষ কামাল হোসেন বিভিন্ন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। বিদ্যালয়ের কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আর্থিক অনিয়ম রোধে ২০২১ সালে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট খোলেন। এ অবস্থায় কতিপয় শিক্ষক ও গভর্ণিং বডির সদস্য জোটবদ্ধ হয়ে বে-আইনীভাবে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। এর পর থেকেই বিদ্যালয়টি শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলে। দেখা দেয় ফলাফল বিপর্যয়।