সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো একধরনের অপরাধ হলেও মাঠ প্রশাসন ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তার ওপর তার প্রচ্ছন্ন প্রভাব অস্বীকার করা যায় না

আতাউর রহমান কানন

৪ জানুয়ারি ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। অফিসের কাজকর্মে তেমন একটা উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বিশেষ করে নির্বাচনি কাজকর্ম যেন রোবটের গতিতে চলছে। এরমধ্যে আমার কাছে ভিজিটরও কয়েকজন আসেন। একথা-সেকথার পর সবাই নির্বাচনের বিষয় জানতে চান। আমি অফিসিয়াল ভাষায় তাঁদের জবাব দিই। আর মিডিয়ার সংবাদে চোখ রাখার জন্য বলি। আমার কর্মকর্তাদের মনও যে অস্থির, তা তাঁদের কথা থেকেই বুঝতে পারি। ডিসি অফিসের নানামুখী কাজের ভিড়ে নির্বাচনি সমস্যা মাঝে মাঝে একবারেই উধাও হয়ে যায়। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবার টেনিস খেলতে যাই। খেলার মাঠ যেন শান্তির জায়গা। খেলা এবং খেলা দেখা উভয়ই মনটাকে ভিন্ন জগতে আবদ্ধ রাখে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। দুঘণ্টা পর টেনিস মাঠ থেকে বাসায় ফিরে আসি।
রাতের সংবাদে শুধু জোট-মহাজোট আর উপদেষ্টাদের কাছে সাংবাদিকদের ছোটাছুটির সংবাদ দেখি। তেমন কোনো সংবাদের মতো সংবাদ নেই।
৫ জানুয়ারি ২০০৭, শুক্রবার। বাইরে কোনো কাজ না থাকায় সারাদিন বাসাতেই থাকি। পত্রপত্রিকা আর টিভি সংবাদের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছি। বলা যায়, ওইসব নিয়েই এখন আমার প্রশাসনিক দিনগুলো কাটছে। না, আজও তেমন কোনো নতুন সংবাদ নেই। রাজনৈতিক জোটগুলো যার যার অবস্থানে অনড়। উপদেষ্টাগণও কেমন যেন নির্লিপ্ত। তবে সাংবাদিকদের ছোটাছুটির শেষ নেই।
৬ জানুয়ারি ২০০৭, শনিবার। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিন। আমি সারাদিন বাসাতেই কাটাই। মহাজোট ও সমমনা দলগুলো কদিন আগে তাদের নমিনেশনপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় নির্বাচন নিয়ে আবার ঘন ধুঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেশে নির্বাচন হবে কি হবে না- এমন আলোচনাই সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। আমার মনে পড়ল- ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার আগে দেশে সংসদ নির্বাচন করেছিল। সে নির্বাচন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে বয়কট করে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল। তারপরও নির্বাচন হয়েছিল এবং সে সংসদ স্থায়িত্ব পায়নি। সরকার গঠনের ১২ দিনের মাথায় বিরোধীদলের তুমুল আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়। তবে এবারও কী তেমন নির্বাচন হতে যাচ্ছে?
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো একধরনের অপরাধ হলেও মাঠ প্রশাসন ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তার ওপর তার প্রচ্ছন্ন প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
রাতের সংবাদে দেখলাম, আগামীকাল থেকে মহাজোট তাঁদের ডাকা দুদিনব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনড়।
৭ জানুয়ারি ২০০৭, রবিবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। আমার ও আমার অধীনস্ত অফিস নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিমূলক কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছে। সারাদেশে মহাজোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি জোরেশোরে চলাতে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ও কাজকর্মে অচলাবস্থা দেখা দেয়। অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি দেখে মনে হয় আগে রাজনীতি, পরে দেশের মানুষ। মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি মোটা দাগে বাদ দিলেও এভাবে যে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজে তা কে না জানে?
আমি ওইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমার প্রশাসনিক জেলার আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার জন্য মনোযোগ দিয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া জেলায় কর্মরত সেনাবাহিনীর দলও টহল বজায় রেখে আমাদের বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করছে।
পরের দিনও অবরোধ কর্মসূচি চলে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। মানুষের জীবনযাপনেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।
আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আমার সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ এসেছিল। তারা বলা যায় একরকম আটকা পড়েছে। সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে খুলে গেছে। তারা বেশ টেনশনে আছে। গভীর রাতের সংবাদে দেখলাম, অবরোধ আর এ মুহূর্তে বর্ধিত হচ্ছে না। তাই ঠিক করলাম, তাদের আগামীকাল সকালেই পাঠিয়ে দেব।
৯ জানুয়ারি ২০০৭, মঙ্গলবার। হবিগঞ্জে এবার বেশ শীত নেমেছে। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ডিআরআরও)কে সালাম দিলাম। তিনি এলে গুদামে রক্ষিত শীতবস্ত্রের একটা হিসাব নিয়ে তাঁকে বললাম, আজ সন্ধ্যার পর সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয় ও শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশন প্লাটফরমে দরিদ্র-শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করব, ব্যবস্থা নিন। ডিআরআরও ‘জি স্যার’ বলে চলে গেলেন।
দেশে অবরোধ কর্মসূচি না থাকায় আজ ডিসি অফিসে লোকজনের সমাগম বেড়েছে। সেইসাথে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। আমি অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে সাক্ষাৎ দিই। নানামুখী সমস্যার কথা শুনি। দেশের রাজনৈতিক এমন অবস্থার মধ্যেও ডিসি অফিসের নানামুখী সেবাপ্রার্থীর অভাব নেই।
ঢাকায় জোট ও মহাজোটের অফিস প্রাঙ্গণে সমাবেশ না থাকলেও নেতাকর্মীদের আনাগোনা ও প্রেস ব্রিফিং অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষের বিবৃতি সংগ্রহে প্রচারমাধ্যমের কর্মীগণ হন্যে হয়ে ছুটছেন। কোনো গরম খবর দিতে পারছেন না। উপদেষ্টাদের নড়াচড়াও থেমে গেছে। সবাই যেন পথহারা পথিক। রাতে পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান, এডিসি জেনারেল, এনডিসি ও অন্যান্য কর্মকর্তাসহ শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য বের হই। প্রথমে সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে যাই। ইউএনও সাহেব দুঃস্থ-শীতার্ত নারী-পুরুষের বিপুল সমাবেশ ঘটিয়েছেন। সেখানে দুই শতাধিক কম্বল ও সোয়েটার বিতরণ করে শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে যাই। প্লাটফরমে এত দুঃস্থ-গৃহহীন যে অবস্থান করে তা এমনভাবে না এলে জানতাম না। আমার টিম সবাইকে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করতে পেরে হ্যাপি।
১০ জানুয়ারি ২০০৭, বুধবার। আমি সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, তেমনি আমার পূর্বনির্ধারিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাসহ পরপর ১০টি মাসিক সভা করি। সারাদিন সভাসমূহ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশের রাজনৈতিক কোনো ভাবনা আজ আর আমাকে পায়নি। তবে রাতে সংবাদ দেখে অনুমান করলাম- দেশ মনে হয় ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। (চলবে…)