হবিগঞ্জে এরশাদের দাখিলকৃত নমিনেশন বাতিল হওয়ার খবর মুহূর্তেই এনটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হতে থাকে

আতাউর রহমান কানন

২১ ডিসেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। জেলা প্রশাসকদের নিজ অফিসের নির্ধারিত সভাসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন কাজকর্মের ওপর পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বাৎসরিক প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নিয়মিত প্রেরণ করতে হয়। এছাড়া বিশেষ প্রতিবেদন তো আছেই। এসব কাজের মধ্যে জেলাধীন বিভিন্ন অফিস ও থানা দর্শন-পরিদর্শন অন্যতম। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যাই থাক না কেন প্রশাসন ব্যবস্থা ঠিক রাখতে আমার কাজ আমাকে করতেই হবে। নচেৎ জবাবদিহি আছে পদে পদে।
আজ সকালে কিছুক্ষণের জন্য নিজ অফিসে বসে স্টাফ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে পূর্বনির্ধারিত পরিদর্শনে যাই। অফিসের কাজকর্মের খোঁজখবর নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজের অগ্রগতি দেখি। এরপর সেখান থেকে এসি (ল্যান্ড) অফিসে যাই। সেখানে বিভিন্ন নথি ও রেজিস্টার পর্যবেক্ষণ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। ভূমি উন্নয়ন করের দাবি ও আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় আদায় কার্যক্রম জোরদার করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দিকনির্দেশনা দিই। এছাড়া নামজারির আবেদনকারীগণের কেউ যাতে হয়রানি না হন, সে বিষয়ে এসি (ল্যান্ড)কে সতর্ক করি।
বিকেল ৩টায় নিজ অফিসে ফিরে নথিপত্রের কিছু কাজকর্ম সেরে বাসায় ফিরে আসি। সন্ধ্যার সংবাদে দেখলাম, নির্বাচন কমিশনার স.ম. জাকারিয়া অফিসে অনুপস্থিত রয়েছেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সারাদেশে রাজনৈতিক সভাসমাবেশ দমানোর ঘোষণা দিয়ে ইতিমধ্যে মোতায়েনকৃত নিষ্ক্রিয় থাকা সেনাবাহিনীকে সক্রিয় হওয়ার আদেশ জারি করেছে। এছাড়া আজ গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রীম কোর্ট ভাঙচুরের ঘটনায় ১৩জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়, যেখানে খ্যাতনামা আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলামও অন্তর্ভুক্ত।
২২ ডিসেম্বর ২০০৬, শুক্রবার। সকালে ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে বাসভবনের অফিসে পেপার নিয়ে বসেছি। এমন সময় সার্কিট হাউজে অবস্থানরত ৩ই বেঙ্গল সেনা ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল মো. মনিরুল ইসলাম আখন্দ টেলিফোনে জানান যে, তিনি আমার বাসায় আসতে চান কিছু বিষয়ে আলাপ করতে। আর সেইসঙ্গে পুলিশ সুপারকে রাখতে বলেন। আমি তাঁকে আধঘণ্টা পর আসতে বলে পুলিশ সুপারকে ফোনে আসতে বলি। সকাল সাড়ে ১০টায় আমরা তিন জন বসে দেশের সর্বশেষ অবস্থা ও সরকারের নির্দেশনা পর্যালোচনা করে হবিগঞ্জের জন্য করণীয় নির্ধারণ করি। সেনাবাহিনী জেলায় এসে অবস্থান নেওয়ার পর এটাই আমাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
২৩ ডিসেম্বর ২০০৬, শনিবার। সকাল ১০টায় আমি অফিসে গিয়ে বসি। সেনাবাহিনী তৎপর হওয়ায় রাজনৈতিক আগুনে পানি পড়েছে। আন্দোলন-সমাবেশের উত্তাপ একেবারেই ঠান্ডা ! নির্বাচন যথাসময়ে হবে ধারণা নিয়ে আমার অফিসও কাজ করে যাচ্ছে। মিডিয়াও কেমন যেন শান্তির খবর পরিবেশন করে যাচ্ছে।
আজ দিন শেষে রাতের টিভি সংবাদে দেখলাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল জলিল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নরম সুরে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলে নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)র চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিএনপি-৪দলীয় জোটের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পক্ষান্তরে খেলাফত মজলিশের দেওয়া ৫দফা শর্ত মেনে আল্লামা আজিজুল হক এর আজিমপুরস্থ বাসায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল জলিল ও খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মওলানা আবদুর রব ইউসুফী একটি নির্বাচনী সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে সুবাতাসের আলামত দেখা দিতে লাগল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আবদুর রব ইউসুফী সাহেব কয়েকদিন আগে তাঁর নিজ বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে এসেছিলেন। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কালে আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আজ তাঁর সেই নুরানি সুফি চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠল।
২৪ ডিসেম্বর ২০০৬, রবিবার। নির্বাচন কমিশনার স.ম. জাকারিয়া ৪২ দিনের ছুটিতে চলে যান। আর আওয়ামী লীগ মহাজোট নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে নির্বাচনে যাবেন বলে সবুজ সংকেত দেয়। তবে ঘোষিত ২২ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের তফসিলে কিছু পরিবর্তনের দাবি করা হয়। বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া মহাজোটের সবুজ সংকেতকে স্বাগত জানান।
২৫ ডিসেম্বর ২০০৬, সোমবার। আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নমিনেশনপত্র দাখিলের শেষ দিন। আমি সকালে অফিসে গিয়ে জানতে পারি- আজ সকল দলই নির্বাচনে নমিনেশনপত্র দাখিল করবে। ঠিক তাই হলো। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে হবিগঞ্জের ৪টি নির্বাচনি এলাকারই নমিনেশনপত্র গ্রহণ করি। হবিগঞ্জ-৩ সদর-লাখাই আসনে এইচ এম এরশাদের পক্ষেও একটি নমিনেশনপত্র দাখিল হয়। রাতের সংবাদে দেখলাম, সারাদেশে এবার ৪,১৪৬টি নমিনেশনপত্র দাখিল হয়েছে।
২৬ ডিসেম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। আজ নমিনেশনপত্রসমূহ বাছাইয়ের দিন ছিল। এদিনই সুপ্রীম কোর্টে এরশাদের সাজার রায় স্থগিত চেয়ে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়; কিন্তু মহামান্য কোর্ট তা প্রত্যাখ্যান করে সাজা ভোগের জন্য এরশাদকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আদেশের কপি ফ্যাক্স মারফত দ্রুত আমার অফিসে চলে আসে। এছাড়া বিরুদ্ধপক্ষের একজন আইনজীবীও হাতে হাতে একটি কপি দাখিল করেন। বাছাইতে আমার আর বেগ পেতে হয় না। এইচএম এরশাদের হবিগঞ্জে দাখিলকৃত নমিনেশনপত্রটি বাতিল হয়ে যায়। আর মুহূর্তের মধ্যে সে সংবাদ এনটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হতে থাকে। রংপুরের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার খন্দকার আতিয়ার রহমান শেষ বিকেলে আমাকে টেলিফোন করে জানতে চান- আমি কীভাবে এরশাদের নমিনেশন বাতিল করেছি। আমি তাঁকে আমার বিষয়টি জানালাম। তখন তিনি জানান যে, তিনি এরশাদ সাহেবের নমিনেশন নিয়ে বিপদেই আছেন। তাঁর অফিস রংপুরের লোকজন ঘেরাও করে রেখেছে। এছাড়া তিনি আমার কাছে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আদেশের কপিসমূহ চাইলে আমি ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দিই। দেশে নির্বাচন এলে যেমন একটা সাড়া পড়ে যায়, আজ সারাটা দিন তেমন অবস্থায় কাটল।
২৭ ডিসেম্বর ২০০৬, বুধবার। সকালে অফিসে গিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকি। কাজেকর্মে অনেকটা গতি ফিরে আসে। যাক, শেষমেশ অনেক ঘাটের জল মাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আহ্বানে রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনমুখী হয়েছে। এখন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ হলেই দেশে নতুন সরকার আসবে; তাতে দেশের অশান্তি দূরীভূত হবে- এ আশা সাধারণ মানুষের। কিন্তু সংবাদ মিডিয়াতে দেখা গেল, সারাদেশে এইচ এম এরশাদের সব নমিনেশন বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকার বিষয়ে পুনরায় ভেবে দেখবে বলে জানায়।
পরের দিন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান যে, জানুয়ারির ২২ তারিখের নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য মহাজোট এরশাদের নমিনেশন বাতিল হওয়াকে অজুহাত হিসেবে নিচ্ছে।
২৯ ডিসেম্বর ২০০৬, শুক্রবার। নির্বাচনের প্রস্তুতি কাজ তদারকির জন্য আমি সকালে অফিসে গিয়ে বসি। আগামী পহেলা জানুয়ারি সোমবার ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষ্যে অফিস ছুটি হয়ে গেছে। আমি নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাড়া বাকি যারা ছুটি চেয়েছে তাঁদের ছুটি দিয়েছি। অফিস বেশ ফাঁকা। জুমার নামাজের বিরতি ব্যতীত সারাদিনই অফিসে কাটাই। আজ সারা দেশে বাতিল হওয়া ২৬৪ জনের নমিনেশনের বিপরীতে এইচ এম এরশাদসহ ৭০ জন প্রার্থী তাঁদের প্রার্থিতা বহাল করার জন্য নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নির্বাচনি মহাজোট নির্ভুল ও হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে পদত্যাগের দাবি তুলে আগামী ৭ ও ৮ জানুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
পক্ষান্তরে বিএনপির মহাসচিব জানান যে, নির্বাচনি সমঝোতা আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের কোনো দাবি উত্থাপিত হয়নি। এখন এসব দাবি অবান্তর।
৩০ ডিসেম্বর ২০০৬, শনিবার। নির্বাচনি বসন্তের লিলুয়া বাতাসে আবার মরুভূমির লু হাওয়া ঢুকে ঘূর্ণি পাকাতে শুরু করে। এর মধ্যেই নির্বাচনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচন হওয়া না-হওয়া নিয়ে নানা কথা চলছে। তবে চ্যানেল টকশোতে বিদগ্ধজন এখন রয়েসয়ে টকটক করছেন।
আজ বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন নিয়ে মহাজোটের চোখরাঙানির তোয়াক্কা না করে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে সিলেট থেকেই তাঁর নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন।
৩১ ডিসেম্বর ২০০৬, রবিবার। একদিকে ঈদুল আজহার ছুটি চলছে, আরেকদিকে নির্বাচনি কাজের জন্য অফিসও খোলা রাখতে হচ্ছে। আমি একবেলা অফিস করে বাসায় চলে আসি। জেলা নাজির আবদুস সামাদকে কোরবানির গরু-ছাগল কিনতে হাটে পাঠাই। সঙ্গে এডিএম জাকীর হোসেনও সখের বসে গিয়েছিলেন। একটি গরু ও একটি খাসি নিয়ে সন্ধ্যার আগেই তাঁরা ফিরে আসেন। আমার সঙ্গে জাকীরও গরু কোরবানির ভাগিদার।
দিন শেষে রাত নামে। সময় গড়িয়ে চলে। চারদিকে ঘন কুঁয়াশার সঙ্গে পৌষের মহিষ কাঁপানো শীতও নেমেছে। এমনদিনে আজ রাত ১২টায় শেষ হয়ে গেল রাজনৈতিক ঘটনাবহুল একটি বছর। রাত পোহালেই ঈদুল আজহা। আমি সবকিছু মিলিয়ে আগামী বছরের শুভকামনায় এ বছরকে বিদায় জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। (চলবে…)