আব্দুল আউয়াল তালুকদার
আজ ২৭ জানুয়ারি। ২০০৫ সালের এইদিনে হবিগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের বৈদ্যের বাজার নামক স্থানে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভিন্ন ইউনিয়নে ঈদ পরবর্তী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান, জাতিসংঘের সাবেক উপ-মহাসচিব, সাবেক অর্থমন্ত্রী, হবিগঞ্জ সদর-লাখাই আসনের সংসদ সদস্য শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে। সমস্ত শরীরে গ্রেনেডের স্পিøন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন হবিগঞ্জের তৃণমূলের কর্মীদের প্রিয় নেতা এডভোকেট মোঃ আবু জহির ভাই। চারজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন। অনেকেই আহত হন। হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে মানুষের আহাজারিতে আর কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ হৃদয় বিদারক পরিণত হলো। হবিগঞ্জ শহরের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত ছিলো, হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে এসে মারাত্মক আহত রোগীদের ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে এসে বড় ভাইকে পেলাম না। পরবর্তীতে বড় ভাই আমাকে ফোনে জানালেন সবাই যার যার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ঢাকা যাচ্ছে, কিন্তু আব্দুল্লাহ সরদারকে ঢাকা নেয়ার মত কেউ নেই। হাসপাতালের বেডে একা আব্দুল্লাহ সরদারকে নিয়ে আমি ঢাকার পথে রওনা দিলাম। বড় ভাই সাথে নিয়ে গেলেন হবিগঞ্জ সদর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কিতাব আলী শাহীনকে। সরকারের মদদে এই নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে যখন আওয়ামী লীগ আন্দোলনে ব্যস্ত তখন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা বলতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কিবরিয়া সাহেবকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ আমার বড় ভাই সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই, নেই কোনো দলীয় কোন্দল, নেই কোনো অভিমান। রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারে সত্যিই আমি নিজেই আশ্চর্য হলাম। সরকারের মন্ত্রীদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো নতুন নাটক বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ঈদ পুনর্মিলনি সভাতে দলের নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ডাকা হলো। হবিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আহমদ খান, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশীদ তালুকদার ইকবাল, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, এডভোকেট আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল, লস্করপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ আরো ৭/৮ জনকে গভীর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। প্রত্যেককেই গভীর রাতে ছেড়ে দেয়া হলো শুধু আমার বড় ভাইকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হলো। সারারাত আমার বাসার সবাই কান্নাকাটি করে। আমার মা একটু পর পর জিজ্ঞাসা করছেন আমার ছেলে আসছে কি-না, সবারই শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা।
বার বার বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের পর জানতে পারলাম বড় ভাইকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে। ৫ দিনের রিমান্ড দেওয়া হয়েছে, বড় ভাইকে চোখ বেঁধে র‌্যাব হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হলো। জয়েন্ট ইন্টারসেশন সেলে হাত-পা বেঁধে এবং ইলেকট্রিক শক দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন। এভাবে গোসল নেই, খাওয়া দাওয়া করতে দেয়া হতো না আমার বড় ভাইকে। পরপর বিভিন্ন মেয়াদে একের পর এক টানা ২৮ দিন রিমান্ড দিয়েছে তৎকালীন সরকার। এর মধ্যে আমার বড় ভাইকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে কেউ জানে না। পরিবারের কোনো সদস্যকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সন্ধান দেয় না। আমাদের ধারণা হয়েছে আমাদের বড় ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়ার মতো, পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই। এমন দুর্দিনে কাউকে পাশে পাইনি।
হবিগঞ্জের তৃণমূল মানুষের প্রিয় নেতা, হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভারতে চিকিৎসাধীন এডভোকেট মোঃ আবু জাহির ভাই আমাকে ফোন করে পরামর্শ দিলেন তুমি ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা কর, তোমার বড় ভাই যে নিখোঁজ এই সমস্ত খবর নেত্রীর নজরে আনো। পরবর্তীতে ঢাকায় গিয়ে ধানমন্ডির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিস্তারিত তুলে ধরলাম। নেত্রী আমার অবস্থা শুনে মর্মাহত হলেন, নেতাদের বলে দিলেন হবিগঞ্জের ইকবাল কোথায় আছে খোঁজ নাও। পরবর্তী সময়ে নেত্রী সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারকে হুশিয়ারী দিলেন। নেত্রী শেখ হাসিনা বড় ভাই নিখোঁজের বিষয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করার জন্য বিনা পয়সায় মামলা পরিচালনার জন্য সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুকে নির্দেশ দিলেন। তৎকালীন বিএনপি জামায়াত সরকার কতটা অমানবিক, তারা মামলার নকল পর্যন্ত গায়েব করেছিলো। মামলার নকল সংগ্রহ করার জন্য কত সময় অপেক্ষা করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। পরবর্তীতে হাইকোর্টে এসে কোর্টের নজরে আনার পরও মামলার নথি তুলতে দেয়া হয়নি। সে দিনগুলোর কথা বিশেষ করে হবিগঞ্জের ফৌজদারী কোর্টে নকল শাখার কাহিনী আমার আজীবন মনে থাকবে।
হবিগঞ্জের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের নিকট কোনো প্রকার সাহায্য পাইনি। অনেকেই ফোন পর্যন্ত রিসিভ করতেন না। বাসায় বলে দিতেন সাহেব বাসায় নেই। বাড়িতে এলে কোনো উত্তর নেই, বড়ভাই বিষয়ে আমার মাকে কিছুই বলতে পারি না। বড় ভাইয়ের অবুঝ বাচ্চাগুলোকে তাদের বাবার বিষয়ে কোনো খবর দিতে পারিনি। কত মানুষের পিছনে ঘুরেছি সন্ধানের জন্য কেউই সহযোগিতা করেনি। আজ এত বছর পরও অনেক সত্য কথা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বলা যাবে না। তাই আমি সবসময়ই বলি বিএনপি এমন অনেক জায়গাতে অনেক নিরপরাধ মানুষদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করেছে বলেই আজ তাদের এই পরিণতি। শেষ পর্যন্ত মাননীয় নেত্রীর কঠোর হুশিয়ারীর কারণে এবং সরকারকে চাপ প্রয়োগ করায় আমার বড় ভাইকে ছাড়তে বাধ্য হয়।
আমার বড় ভাইকে শারীরিক আঘাতের চিহ্ন এবং কানে কম শুনে, রাতে শরীর ব্যথায় ঘুমাতে পারে না। বড় ভাই নিজের কষ্টের কথা অন্যকে শোনাতে চায় না, তাই সবসময় নিজের কষ্টের কথা আড়ালে রেখেছে। ২৮ দিনের রিমান্ডের দিনগুলির কথা সভা সমাবেশে তেমনভাবে বলেনি। তবে আমার দুর্দিনে পাশে ছিলেন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কারা নির্যাতিত নেতা আতাউর রহমান সেলিম ভাই এবং সবসময় যোগাযোগ ও সাহস যুগিয়েছেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আবু জাহির ভাই এবং সাবেক সংসদ সদস্য চৌধুরী আব্দুল হাই।
প্রতি বছর ২৭ জানুয়ারি আসলে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে আমার বড় ভাইয়ের উপর ঘটে যাওয়া বর্বরতার ঘটনায় কেউ দুঃখ প্রকাশ করেনি। অথচ হবিগঞ্জের সকলেরই জানা আমার বড় ভাই ক্লিন ইমেজের অধিকারী মানুষ।