মাকালকান্দির ভয়াল দিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও নীরবে-নিভৃতে চোখের অশ্রুপাত করেন বেঁচে থাকা স্বজনরা

ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বানিয়াচংয়ে জন্ম নেওয়া ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গ

আতাউর রহমান কানন

চতুর্থ পর্বের ধারাবাহিকতায়…

৬. মাকালকান্দি স্মৃতিসৌধ: বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কাগাপাশা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম মাকালকান্দি। ১৮ আগস্ট ১৯৭১ সালের সকালবেলা গ্রামের চন্ডীমন্দিরে মনসা পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিল হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রামের বাসিন্দারা। এ সময় ৪০-৫০টি নৌকাযোগে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী এসে হামলা চালায়। পূজারত নারী-পুরুষকে চন্ডি মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে পাকহানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একই পরিবারের ১১ জনসহ মোট ১৪১ জনকে হত্যা করে। ঘাতকরা সেদিন নারীদের সম্ভ্রমহানিও ঘটায়। পরে হানাদার-দালালবাহিনি গ্রামবাসীর মালামাল লুট করে নিয়ে যায় এবং বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও নীরবে-নিভৃতে চোখের অশ্রুপাত করেন বেঁচে থাকা স্বজনরা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকীর প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ ব্যক্তিদের নামের তালিকাসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখন প্রতিবছর ১৮ আগস্ট ‘মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
বানিয়াচং শুধু এশিয়ার একটি বৃহত্তম গ্রামই না, এর নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে এখানে জন্ম নেওয়া উল্লেখযোগ্য ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গ। এঁদের মধ্যে যাঁদের নাম না বললেই নয় তাঁরা হলেন:-
১. মোহম্মদ আবদুর রব (মেজর জেনারেল এমএ রব): তাঁর জন্ম ১২ মার্চ ১৯১৯, মৃত্যু ১৪ নভেম্বর ১৯৭৫। বানিয়াচং উপজেলার কুর্শা-খাগাউড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই চিরকুমার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দ্বিতীয় অধিনায়ক। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে। এছাড়া ২০০০ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক ২০০০ দেওয়া হয়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হিসেবে ১৯৭০ সালে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতিতে যোগদান করেন। ওই বছরই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় বৃহত্তর সিলেট জেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-২০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ক্রমান্বয়ে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন এম এ জি ওসমানী। চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পান এম এ রব। তিনি পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর সদরদপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। ১৪ ডিসেম্বর এম এ জি ওসমানী ও তিনি হেলিকপ্টারে সিলেটে যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শনকালে ফেঞ্চুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করে। তখন তাঁর পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়।
যুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অক্রিয়) পদবী লাভ করেন। হবিগঞ্জ শহরের উপকন্ঠে উমেদনগরে চিরকুমার এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে।
২. ফজলে হাসান আবেদ: বানিয়াচংয়ের কৃতী সন্তান ব্র্যাক-এর প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি লন্ডনে অ্যাকাউন্টেন্সি বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং কস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট হন। পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানির সিনিয়র কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নাটকীয়ভাবে তাঁর জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়। চাকরি ছেড়ে তিনি লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন গড়ে তোলার সক্রিয় উদ্যোগ নেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসে এবং অর্থনীতির ভগ্ন ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশের প্রত্যাগত শরণার্থীদের সহায়তায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় ‘ব্র্যাক’ গড়ে তোলেন। দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটানোই ছিল প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য।
ব্র্যাক এখন বিশ্বের এক নম্বর এনজিও যার কার্যক্রম এশিয়া ও আফ্রিকার এগারোটি দেশে পরিচালিত হচ্ছে। সামাজিক ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ফজলে হাসান আবেদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারিদ্র্য হ্রাসে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ ক্রাউন ২০০৯ সালে তাঁকে দ্য মোস্ট ডিস্টিংগুইশড অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জ (নাইট) উপাধিতে ভূষিত করেন।
৩. মনসুর বয়াতী: মধ্যযুগের শেষদিকের বিখ্যাত কবি ও বাউল শিল্পী ছিলেন। বানিয়াচং পরগনার অধিবাসী বলে অনেকেই বলে থাকেন। তিনি মূলত পল্লিকবি ও গায়ক। মৈমনসিংহ-গীতিকার ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালাটি তিনিই রচনা করেন। গবেষক চন্দ্রকুমার দে হবিগঞ্জের বানিয়াচং থেকে পালাটি সংগ্রহ করেন। বানিয়াচং-এর এক দেওয়ান পরিবারের কাহিনি এর উপজীব্য। পালাটি সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে ‘অবং দুলাল’ নামে প্রচলিত। আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় পালাটির রচনাকাল ১৮শ শতকের গোড়ার দিকে বলে অনুমান করা হয়। মনসুর বয়াতী লৌকিক ধারার একজন শক্তিমান কবি ছিলেন। করুণ রস সৃষ্টিতে তাঁর দক্ষতার পরিচয় অপরিসীম।
৪. রামনাথ বিশ্বাস: ভূপর্যটক বা পরিব্রাজক রামনাথ বিশ্বাসের জন্মস্থান এই মহাগ্রাম বানিয়াচংয়ে। সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে ৭ হাজার, রেলগাড়িতে ২ হাজার এবং জাহাজে ২৫ হাজার, মোট ৮৭ হাজার মাইল (১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার) ভ্রমণ করা এই মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, সর্বভুক, নির্লোভ ও ভীষণ সাহসী। চিরকুমার রামনাথকে নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার জাত আছে কি নেই?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন- ‘আমার জাতপাত সব চলে গেছে, আছে শুধু বাঙালিত্ব।’
১৯৩২ সালের মাঝামাঝি রামনাথকে ইমিগ্রেশনের অদ্ভুতুড়ে আইনের কারণে ২৯ দিন একটানা কানাডার একটি কারাগারে থাকতে হয়। সে সময় ভারতবর্ষের অধিবাসীদের জন্য কোথাও তেমন একটা দুয়ার খোলা ছিল না। রামনাথ সবসময়ই বলতেন- ‘অর্থের প্রতি লোভ করলে আর পর্যটন হয় না, লোভীরা কখনও ভ্রমণ করতে পারেন না।’ বিচিত্র সব কোমল-কঠিন অভিজ্ঞতায় ভরপূর তাঁর সারা জীবন। চীনে বিপ্লব চলাকালীন সময়ে মাও সে তুং-এর সঙ্গে দেখা করেছেন প্রবল উচ্ছ্বাসে, আফ্রিকায় হায়েনার সাথে একই জলায় জলপান করেছেন, বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়ে পাশে কোনো শ্বেতাঙ্গ না বসায় একা বাসে চেপে দেখতে গিয়েছেন নায়াগ্রা, ভাড়াটে খুনের গুলির সামনে পড়েছেন, বিস্তর আঘাত পেয়েছেন শরীরে ও মনে। তাঁর বিচিত্র সব ভ্রমণের গল্পের জন্য অপেক্ষায় থাকতো সারা বাঙ্গালি জাতি। যাঁদের মধ্যে গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ৩২টি বই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ভবঘুরে জীবন নিয়ে। ‘রামনাথের পৃথিবী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভূপর্যটক ১৯৪০ সালের ২৬শে এপ্রিল বিশ্ব ভ্রমণ শেষ করে একদিন বিশ্বকবির শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যান। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর বিশ্বজয়ী সাইকেলটি বিশ্বকবিকে উপহার দিয়ে নিজে ধন্য হবেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বললেন, রামনাথ তোমার লেখা আমি পড়ি। অবিশ্বাস্য ছোট্ট এই বাক্যটুকু কানে পৌঁছানো মাত্র চিরাচরিত স্বভাব তেড়ে ফুঁড়ে আছড়ে পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বয়ং রবি ঠাকুর বলে কথা! তবে শত হলেও রামনাথও বটে! মেঝের দিকে নতদৃষ্টিতে মাথা চুলকে ধীর গলায় উগড়ে দিলেন- গুরুদেব অধমের কাছে মিথ্যা বলে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? এক পলক অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে মুচকি হেসে রবীন্দ্রনাথ হাঁকলেন- অনিল, ‘দেশ’ পত্রিকাগুলো নিয়ে এসে দেখাও তো পর্যটক মশাইকে। কবির প্রিয় পাত্র অনিল চন্দ ত্বরিতে ‘দেশ’ পত্রিকার বেশ কয়েকটি সংখ্যা রামনাথের হাতে ধরিয়ে দিলে রামনাথ সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, তাঁরই লেখা পাতার পর পাতা আন্ডার লাইন করা। লজ্জায় ও সংকোচে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর। মসৃণ আয়না সদৃশ রামনাথের কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে এবং চমকে চমকে উঠে ভাবছেন, ‘এও কি সম্ভব! আমার মতো অধম লেখকের লেখা বিশ্বকবি এভাবে পড়েন?’
দেশভাগের পর রামনাথ বানিয়াচংয়েই অবস্থানের চেষ্টা করেছিলেন, পরে নানা পরিস্থিতিতে একেবারেই কালকাতায় চলে যান। সেখানে একটি প্রকাশনা সংস্থা দিয়ে নিজের বই প্রকাশ করেছিলেন বেশ কয়েকটা। এই বিশ্ব পরিব্রাজক ১৯৫৫ সালে মাত্র ৬১ বছর বয়সে অন্য জগতের ভ্রমণে চলে যান।
৫. সিরাজুল হোসেন খান: তিনি তথ্যমন্ত্রী, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এবং একজন সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন।
৬. ইয়াহিয়া খান চৌধুরী, কুষ্টিয়া ও ঢাকা জেলার প্রথম বাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য।
২. জাকারিয়া খান চৌধুরী, কবি, মানবকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, ভাষা সৈনিক, সাবেক সংসদ সদস্য, জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা। ইংল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে বর্তমান সরকার তাঁকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
৭. সুবীর নন্দী: বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে জন্ম নেওয়া এই গুণী সংগীত শিল্পীর শৈশব কেটেছে বাবার কর্মস্থল তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের জন্য তিনি পাঁচবার বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ৭ মে ২০১৯ সালে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। (চলবে…)