শিলং জুয়ায় জড়িয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে রাতের আঁধারে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়েছেন আজমিরীগঞ্জ বাজারের ধান চাউল ব্যবসায়ী নাসির মিয়া

আজমিরীগঞ্জ প্রতিনিধি ॥ আজমিরীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ উপজেলার জলসুখা ও সদর ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরে চলছে শিলং জুয়া। শিলং জুয়া খেলে ইতোমধ্যে সর্বশান্ত হয়ে গেছে অনেক পরিবার। হারিয়েছে অনেক পরিবারের সুখ শান্তি। অনেকে আবার ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। অতি লোভে পড়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষ শিলং জুয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। শিলং জুয়া খেলায় এক টাকায় সত্তর টাকা পাওয়া যায় এমন প্রচারে সাধারণ মানুষ লোভে পড়ে বিকেল হলেই কাজ-কাম ফেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জুয়া খেলায়। মাঝে মাঝে শোনা যায়- এক্স ওয়াই জেড শিলং জুয়া খেলে এক লাখ-দুই লাখ টাকা পেয়েছে। এটি সত্যি নাকি শুধুই প্রচার প্রচারণা তা আজও কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেননি। এসব অপপ্রচারে গ্রামের সহজ সরল মানুষ লোভে পড়ে শিলং জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে। দিনের পর দিন টাকা খুইয়ে তিল তিল করে সর্বশান্ত হচ্ছেন তারা। তবে শিলং তীর জুয়া খেলে সকলেই যে সর্বশান্ত হচ্ছেন তা কিন্তু নয়, লাভের তালিকা ছোট হলেও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন এর এজেন্টরা। আজমিরীগঞ্জের বেশ কয়েকজন এজেন্ট রাতারাতি জায়গা জমির মালিক হয়ে দালান কোটা নির্মাণ করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- দিনের পর দিন প্রকাশ্যে নতুন নতুন এজেন্ট নিয়োগ করে শিলং জুয়া খেলার প্রসার হচ্ছে। কিন্তু সর্বনাশা এ খেলা বন্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
আজমিরীগঞ্জ বাজারের ধান চাউল ব্যবসায়ী নাসির মিয়া। ব্যবসায় আয়-উন্নতি ভালোই ছিল। হঠাৎ সঙ্গদোষে অনলাইন ভিত্তিক শিলং তীর জুয়ায় জড়িয়ে দিনে দিনে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তার প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা দেনা হয়ে যায়। এক পর্যায়ে ঋণের জ¦ালায় পরিবার পরিজন নিয়ে রাতের আঁধারে তিনি আজমিরীগঞ্জ থেকে পালিয়ে যান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করছেন। যায় দোকানে এক সময় ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করতো শিলং জুয়ায় জড়িয়ে আজ তিনি নিঃস্ব। নিজে হয়েছেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিক। শুধু নাসির মিয়াই নয়, শিলং তীর খেলায় জড়িয়ে নিঃস্ব হয়েছে আজমিরীগঞ্জের অসংখ্য পরিবার। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে হাওরের জমিজমা বিক্রি করে এখন নিঃস্ব।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘তীর’ খেলা মূলত ভারতের শিলং থেকে পরিচালিত হয়। সেখানকার ক্লাবের মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীরা বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ করে। বাংলাদেশী এজেন্টরা আবার বিভিন্ন এলাকায় তাদের মুহুরী নিয়োগ করে। এসব মুহুরীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে শিলং তীরে আসক্ত করা হয়। পরে তাদের কাছ থেকে টাকা কালেকশন করা হয়। মূল এজেন্টের কাছ থেকে কালেকশনের ৩০% টাকা কমিশন পেয়ে থাকে মুহুরীরা। এ খেলার জন্য ভারতের শিলংভিত্তিক ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত শুন্য থেকে নিরানব্বই পর্যন্ত নম্বরগুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে। এই নম্বরগুলো যারা কেনেন তাদের সাথে মুহুরী যোগাযোগ করে। জুয়াড়িরা মুহুরীদের কাছ থেকে শুন্য থেকে নিরানব্বই নাম্বারের মধ্যে থেকে নিজের পছন্দের নাম্বার বাছাই করে ওই নাম্বারের বিপরীতে টাকা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করে। কেউবা আবার মোবাইল এসএমএস সংরক্ষণ করেন। শিলংয়ে রবিবার ব্যতীত সপ্তাহের ৬ দিন এই জুয়া খেলার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম রাউন্ড ও দ্বিতীয় রাউন্ড নামে দুটি ড্র হয়। এতে শুন্য থেকে ৯৯ এর মধ্যে একটি নম্বর বিজয়ী হয়। যারা ওই নম্বরটি ক্রয় করে থাকেন তারা বিজয়ী হিসেবে গণ্য হন এবং বিজয়ীরা নম্বরের ক্রয়মূল্যের ৭০ গুণ টাকা এজেন্টের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ জুয়াড়ি বিজয়ী হতে না পেরে তাদের পুঁজি হারিয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে কোন জুয়াড়ি বিজয়ী হয়ে কিছু টাকা পেলেও পরবর্তীতে আরও টাকা পাওয়ার নেশায় জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এভাবেই এ খেলায় আসক্তরা দিনের পর দিন টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।
সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গৌহাটি এলাকায় ১৯৯০ সালে চালু হয় ‘শিলং তীর’ নামের ওই জুয়া। পরবর্তীতে অনলাইনের মাধ্যমে এটি সিলেটে বিস্তার লাভ করে। ২০১৩ সালে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের কিছু যুবক সিলেটের জাফলং পাথর খোয়ারিতে কাজে যায়। সেখান থেকেই তারা এই খেলা রপ্ত করে। পরবর্তীতে এই যুবকদের হাত ধরেই আজমিরীগঞ্জের সর্বত্র ‘শিলং তীর’ জুয়া ছড়িয়ে পড়ে। পাতানো এই খেলায় জড়িয়ে একদিকে যেমন নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে জুয়াড়িদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতে। করোনাকালীন সময়ে কিছুদিন এই খেলা বন্ধ থাকলেও বছরখানেক ধরে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বর্তমানে পৌর এলাকার মুন সিনেমা হলের সামনে কয়েকটি চায়ের দোকান, একই রোডের কাপড়ের দোকান, টানবাজারের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কাকাইলছেও রোডে কাঠ পট্টি ও কয়েটি গ্রামে এ জুয়া বেশি পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই খেলায় জড়িত এক যুবক জানান, বিগত কয়েক মাস ধরে আজমিরীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। তারা পুরনো জুয়াড়িদের পাশাপাশি নতুন যুবকদের শিলং তীর খেলায় উদ্বুদ্ধ করছে। এমনকি উপজেলার অনেক নারীও এই জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, আজমিরীগঞ্জ পৌরসভায় ৫টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্তত ৪০ জন মুহুরী সক্রিয় রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এজেন্ট জানান, তাদের প্রতিটি গ্রুপের সদস্যদের মাসোয়ারা দিতে হয়। কেউ সপ্তাহে ১০ হাজার আবার কেউবা ৩ হাজার টাকা করে মাসোয়ারা দেন।