দুই কোটি টাকার বিনিময়ে এমপি আবু জাহিরকে এবং দশ কোটি টাকার বিনিময়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে হত্যা করবে মর্মে জি কে গউছের সাথে মৌখিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ইলিয়াস মিয়া ওরফে ছোটন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপি নেতা জি কে গউছ বর্তমানে যে মামলায় কারাবন্দী সেই মামলাটি এখন সারা জেলায়, এমনকি সারা বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী হবিগঞ্জের লোকজনের মধ্যে আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। ওই মামলায় জি কে গউছের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছে? মামলায় জি কে গউছের সাথে আরো কারা আসামী? মামলা দায়েরের ৮ বছর পর মামলাটির প্রাণ ফিরে পাওয়া!- এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক পাচ্ছে মানুষের মাঝে। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো মামলার বিস্তারিত বিবরণ।
হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোঃ সানা উল্লাহ ২০১৫ সালের ২৮ আগস্ট হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় ৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা হলেন- বিএনপি নেতা জি কে গউছ, শায়েস্তাগঞ্জের দাউদনগরের ছালেহ আহম্মদ কনার ছেলে হাজতী-৪১১৩/১৪ ইলিয়াস মিয়া ওরফে ছোটন (২৮), হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগরের গোলাম রহমান ওরফে আলফুর ছেলে গোলাম কাউছার ঝলক ওরফে জি কে ঝলক (২৫), শায়েস্তানগরের মৃত জিতু মিয়ার ছেলে শফিকুর রহমান সেতু (২৮), বাহুবল উপজেলার ৭নং ভাদেশ্বর ইউনিয়নের সাহাপুর (ভাদেশ্বর) গ্রামের মৃত মোজাফ্ফর উল্লার ছেলে আব্দুর রউফ বাহার (৪৩)সহ অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজন।
মামলার এজাহারে জি কে গউছসহ আসামীদের বিরুদ্ধে বর্ণিত উল্লেখযোগ্য অভিযোগসমূহ নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো-
গত ১৮/০৭/২০১৫ইং তারিখ সকাল অনুমান ৯ ঘটিকায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা ১। হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার মামলা নং-২৭, তাং- ২৮/০১/০৫ইং ধারা ১২০-বি/৩২৪/৩২৬/৩০৭/৩০২/০৪/২১২/১০৯ পি.সি, দ্রুত বিচার (দায়রা) ১১/০৬ (সিলেট), ২। হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার মামলা নং-২৮, তাং-২৮/০১/০৫ইং ধারা ১৯০৮ইং সনের বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইনের ৩ মামলা দুইটির চার্জসীটভুক্ত ও হবিগঞ্জ জেলা কারগারে অন্তরীণ আসামী হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ এবং একই কারাগারের অপর দুইটি হত্যা মামলা যাহা (১) দায়রা নং-৩৭৯/১১ এবং দায়রা নং-৩৪৮/০৯ মামলায় অন্তরীণ আসামী হাজতী-৪১১৩/১৪ ইলিয়াস মিয়া ওরফে ছোটনদের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে আসামী ইলিয়াস মিয়া ওরফে ছোটন হবিগঞ্জ সদর-লাখাই আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব এডভোকেট আলহাজ্ব মোঃ আবু জাহির ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত মহোদয়দের হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে আর্থিক লেনদেন এর বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেওয়ার কারণে উক্ত হাজী আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটন আসামী জি কে গউছকে ১৮/০৭/১৫ইং তারিখ সকালে আক্রমণ করিয়া আহত করিলে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলার শামীম ইকবাল এর অভিযোগের প্রেক্ষিতে আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটন এর বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার মামলা নং-১৭, তাং-১৮/০৭/১৫ইং ধারা-৩৪১/৩২৪/৫০৬ পি.সি রুজু হয়। উক্ত মামলার তদন্তের স্বার্থে বিজ্ঞ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটনকে পুলিশ রিমান্ডে আনিয়া জিজ্ঞাসাবাদে সে মামলার ঘটনার সহিত জড়িত থাকার সত্যতা স্বীকার সহ গত ২৭/০৭/১৫ইং তারিখ বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় নিজেকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি প্রদান করে। উক্ত স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দিতে আসামী ইলিয়াস মিয়া ওরফে ছোটন প্রকাশ করে যে, সে দীর্ঘদিন যাবৎ হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে বিভিন্ন হত্যা মামলায় আটক রহিয়াছে। একপর্যায়ে গত ২৮/১২/১৪ইং তারিখ উক্ত মেয়র জি কে গউছ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় বিজ্ঞ আদালতে আত্মসমর্পণ করিলে এবং বিজ্ঞ আদালত তাহার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করিয়া তাহাকে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে প্রেরণ করেন। এরই কিছুদিন পর উক্ত মামলার চার্জসীটভুক্ত অপর আসামী সিলেট সিটি করপোরেশন এর সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিজ্ঞ আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়া জামিন আবেদন করিলে, বিজ্ঞ আদালত তাহার জামিন নামঞ্জুর করিয়া তাহাকেও হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করেন। উক্ত দুই মেয়র কারাগারের ডিভিশন প্রাপ্ত হাজতী। সেখান থেকে আসামী জি কে গউছ উক্ত সময়ে কারাগারে আটক থাকা আসামী গোলাম কাউছার ঝলক ওরফে জি কে ঝলক ও শফিকুর রহমান সেতু দ্বয়কে পাঠিয়ে ইলিয়াস মিয়া ছোটনকে ডিভিশন প্রাপ্ত হাজতী আসামী জি কে গউছের সহিত দেখা করার জন্য একাধিকবার সংবাদ পাঠায়। একপর্যায়ে ডিভিশন প্রাপ্ত হাজতী আসামী আরিফুল হক চৌধুরী হবিগঞ্জ জেলা কারাগার হইতে অন্য কারাগারে চলিয়া যাওয়ার মাস খানেক পর পুনরায় গোলাম কাউছার ঝলক ও শফিকুর রহমান সেতু সেলে গিয়ে ইলিয়াস মিয়া ছোটনকে জি কে গউছের সহিত দেখা করার জন্য বলিলে হাজতী আসামী ইলিয়াছ মিয়া ছোটন কারাগারের সাবেক জেল সুপার নুরশেদ আহম্মদ ভূঁইয়ার অনুমতিক্রমে কারাগারের সুবেদার জহির ও সিআইডির (কারারক্ষী) আনোয়ারের সহায়তায় এক সময় জি কে গউছের রুমে তাহার সহিত দেখা করে। ঐসময় মেয়র জি কে গউছের রুমে বসে হবিগঞ্জ সদর-লাখাই আসনে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আলহাজ্ব এডভোকেট মোঃ আবু জাহির এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত মহোদয়কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করে। ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনায় মেয়র জি কে গউছ ইলিয়াস মিয়া ছোটনকে জানায় আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটন দীর্ঘদিন যাবৎ জেলা কারাগারে আটক থাকায় সে তাহার জামিনের শর্তে এবং হবিগঞ্জ সদর-লাখাই আসনের মাননীয় এমপি মহোদয়কে দুই কোটি টাকা এবং অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে দশ কোটি টাকার বিনিময়ে সে জামিনে মুক্তি পাইয়া হত্যা করিবে মর্মে মৌখিক চুক্তিবদ্ধ হয়। আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটন এর জেলা কারাগারের একাউন্ট (পিসি) তে এডভান্স দশ লক্ষ টাকা জি কে গউছ জমা দিবে বলিয়াও মৌখিক চুক্তি হয়। এসময় আসামী ইলিয়াস মিয়া ও ছোটন মেয়র জি কে গউছের সহায়তায় জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর গেইটের বাহির হইতে মেয়রের লোক ইউনুছ মিয়া সহ কয়েকজন তাকে রিসিভ করিয়া দিয়া গিয়ে বাকী কাজ বুঝাইয়া দিবে বলিয়া মেয়র জি কে গউছ জানায়। এরপর ইলিয়াস মিয়া ছোটন তাহার সেলে চলিয়া আসে। এর ভিতরে মেয়র জি কে গউছের অনুসারী আরো কিছু লোক সেলে গিয়ে ইলিয়াস মিয়া ছোটন এর সাথে দেখা করে উক্ত বিষয়ে কাজের তাগিদ দিয়াছে বলিয়া আমাদের নিকট জানায়। ঈদুল ফিতরের আগের দিন ১৭/০৭/১৫ইং তারিখ কারাভ্যন্তরে থাকা হাজতী আব্দুর রউফ অপর আসামী ইলিয়াস নিয়া ছোটন এর সহিত দেখা করিয়া সে কেন জি কে গউছের কাজ করিতেছে না বলিয়া গালিগালাজ করিয়া চলিয়া যায়। একপর্যায়ে ঈদুল ফিতরের দিন অর্থাৎ গত ১৮/০৭/১৫ইং তারিখ জেলা কারাগারের ভিতরে সকালে ঈদের নামাজ শেষ করিয়া একে অন্যের সহিত কোলাকুলি করাকালে মেয়র জি কে গউছের নির্দেশ মতে আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটন কোন কাজ না করায় মেয়র জি কে গউছ তাকে গালিগালাজ করে এবং তাহার রুমে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করে। একপর্যায়ে আসামী ইলিয়াস মিয়া ছোটন জি কে গউছ এর সহিত বাহির হইয়া তাহার রুমে যাওয়ার পথে কারাভ্যন্তরের ওয়ার্ড ও সেলের সামনের রাস্তায় পৌছিলে মেয়র জি কে গউছ ও তাহার লোকজন তাহাকে আক্রমণ করিতে পারে আশংকা করিয়া সে নিজেই পূর্ব হইতে পকেটে থাকা সূচালো হালকা বাকা স্টিল জাতীয় বালতির হাতল দ্বারা মেয়র জি কে গউছ এর পিঠের ডান সাইডে ঘাই মারিয়া আহত করে। সার্বিক অবস্থায় উল্লেখিত আসামী জি কে গউছ, ইলিয়াস মিয়া ওরফে ছোটন, জি কে ঝলক, শফিকুর রহমান সেতু ও আব্দুর রউফ বাহার সহ অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজন আসামী জেলখানার মত গুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ ও সংরক্ষিত স্থানে বসিয়া এবং বাহিরের অজ্ঞাত লোকজনের সহায়তায় বিগত ২৮/১২/১৪ইং তারিখ হইতে ১৮/০৭/১৫ইং তারিখ পর্যন্ত সকল আসামীগণ বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের সহায়তায় অপরাধমুলক গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উক্ত এমপি ও মন্ত্রী মহোদয়কে হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করিয়া পেনাল কোডের ১২০-খ ধারার অপরাধ করিয়াছে বলিয়া প্রতীয়মান হওয়ায় তাহাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজুর লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিলম্বে অত্র এজাহার দায়ের করিলাম।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই পবিত্র ঈদ উল ফিতরের দিন হবিগঞ্জ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় জি কে গউছকে ছুরিকাঘাত করার ঘটনায় হবিগঞ্জ কারাগারের তৎকালীন জেলার মো. শামীম ইকবাল বাদি হয়ে হামলাকারী ইলিয়াসকে একমাত্র আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর মডেল থানার তৎকালীন এসআই সাহিদ মিয়া। ১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল আলীম আসামী ইলিয়াসকে দেড় বছরের কারাদন্ড দেন।
অপরদিকে, ওই সময়ে হবিগঞ্জ সদর থানার এসআই সানা উল্লাহ বাদি হয়ে জি কে গউছকে প্রধান আসামী করে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মোহিত এবং হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ আবু জাহিরকে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়। এ মামলাটি দায়েরের পর কেটে গেছে প্রায় ৮ বছর। জি কে গউছ কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে হবিগঞ্জ শহরে পুরোদমে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। বসবাস করছিলেন তার নিজ বাসায়। গত ২৭ আগস্ট ২০২৩ ইং হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি (তদন্ত) বদিউজ্জামান অতিরিক্ত কমিশনার ডিবি বরাবরে একটি আবেদন করে বলেন- উল্লেখিত মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি জি কে গউছ দীর্ঘদিন যাবত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাকে গ্রেফতারে অতিরিক্ত কমিশনার ডিবি’র সহযোগিতা চান। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৯ আগস্ট ২০২৩ ইং রাত ৯টার দিকে ডিবি পুলিশ ঢাকার কাকরাইল এলাকা থেকে জি কে গউছকে আটক করে। বর্তমানে জি কে গউছ উক্ত মামলায় হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে বন্দী রয়েছেন।