আমি ছিলাম ‘ক্লোজ টু ডেথ’
জালাল আহমেদ

১৯৯৪ সালের মার্চ মাসের ঐ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটির প্রতি ওয়ার্ডের জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সম্ভবতঃ বাংলাদেশে সেবারই প্রথম প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট দেবার জন্য ৪৩ জন ম্যাজিস্ট্রেটকে সিআরপিসি অনুযায়ী বিশেষ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে সিএমএম এর অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। জ্যেষ্ঠ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সমন্বয়ের দায়িত্ব আমার উপর পড়ে। সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রামের জনৈক মন্ত্রী ফোন করে জামাল খান এবং অন্য একটি ওয়ার্ডের ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রত্যাহার করতে বলেন। আমি বললাম যে স্যার, কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা’ দিতে পারেন। যেহেতু তাঁরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে দায়িত্ব পালন করছে সেহেতু এভাবে তাঁদের প্রত্যাহার করা যাবে না। দুপুরের পর মন্ত্রীর একান্ত সচিব পানছড়িতে আমার একসময়ের সহকর্মী নাজিমুদ্দিন চৌধুরী ফোন করে এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলেন। আমি বললাম যে আপনার মন্ত্রী না বুঝতে পারেন, আপনি তো বুঝেন যে এটা সম্ভব না, মন্ত্রীকে তাই বলেন। নির্বাচন হয়ে গেল এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিজয়ী হলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রথম বিজয়। তারপরের নির্বাচন ১৯৯৯ সালে, তখনো আমি ঢাকা থেকে এসে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। তারপর আরো একবার তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন।
ততদিনে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমার ৩ বছর পার হয়েছে। আমার বন্ধু এওয়াইএম একরামুল হক তখন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে আমাদের বদলি করার মালিক মোখতার। দুই বছর পার হবার পর থেকেই তাঁকে ফোনাঘাত করি আমার কি হচ্ছে তা জানার জন্য। এসময়ে আমার পদায়ন হল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নবসৃষ্ট পদ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ১৯৭৩ ব্যাচের মোঃ আলাউদ্দিন এর পদায়ন হল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে। তিনি আমাকে খবর দিলেন, গেলাম দোতলায় তাঁর চেম্বারে। তিনি বললেন যে আমাকে চট্টগ্রামের এক মন্ত্রীর সংগে দেখা করতে হবে আমার পদায়নের ব্যাপারে। আমি বললাম কেন? তিনি বললেন মন্ত্রীর সম্মতি না থাকলে আমার এই পদায়ন বাতিল হয়ে যাবে। আমি বললাম যে স্যার, চট্টগ্রামে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছি মন্ত্রীর সংগে পরিচিত না হয়েই। এখন এই পদায়নের জন্য মন্ত্রীর সংগে দেখা করার কোন আগ্রহ আমার নাই। তিনি বললেন যে তোমার পদায়ন বাতিল হয়ে যাবে। আমি বললাম হলে তাই হোক, স্যার। কয়েকদিনের মধ্যে আমার অর্ডার বাতিল হল। আর মোঃ আলাউদ্দিন সাহেব যোগদান করলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে। প্রথম প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করলেন ১৯৮১ ব্যাচের ইকবাল মাহমুদ।
একদিন কোর্ট করে বিকেলবেলা বাসায় যাবো বলে বের হচ্ছি। আগে যেমন উল্লেখ করেছিলাম আমি সাধারণতঃ কোর্ট করে নেমে কোর্ট চেম্বারে বসে রায় লিখতাম। বাসায় যেতে একটু দেরী হত কারণ সহকর্মী মাঈনুদ্দিন খোন্দকার (মরহুম, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এর সদস্য) পুলিশ ফাইল করতে নামতে দেরী করতেন। কারণ তিনি আইনজীবীদের সংগেও প্রচুর বাক্য বিনিময় করতেন, দীর্ঘ শুনানী নিতেন। ঐদিনও একটু বিলম্বে আমরা বের হয়ে আদালতের প্রধান গাড়ি বারান্দায় রাখা গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন এক বড় সাদা দাড়িওয়ালা লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে আচমকা আমার পায়ে ধরে সালাম করার চেষ্টা করলো। আমি আরে আরে কি করেন বলে পিছিয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কে আপনি? বললো যে আমি সুলতান। আমি মুহূর্তে বুঝে গেলাম যে এ হল খুদুকখালী’র সুলতান। বললাম যে আপনিতো কখনো আমার কাছে আসেননি। সে জবাব দিল, “স্যার, আমরা ভাবছিলাম যে আপনি এমপি সাহেবের লোক কিন্তু পরে বুঝতে পারছি যে তা না। আমরা তারপর থেকে ভালো আছি, আপনার জন্য দোয়া করি।” আমার ভালো লাগলো বাঁশখালী থেকে চলে আসার পাঁচবছর পর খুদুকখালী উপকূলীয় মোহাজের সমিতির নেতা সুলতানের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি পেয়ে।
১৯৯৪ সালের জুলাই মাস। চট্টগ্রামে গোলাম আজমের জনসভা। তখন গোলাম আজম সম্ভবতঃ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে মাত্র এবং জামাতের শক্তিকেন্দ্র হিসাবে লালদিঘীতে জনসভায় যোগ দিতে চট্টগ্রাম আসে। স্বভাবতঃই আওয়ামী লীগ তাকে প্রতিরোধের ডাক দেয়। সারা শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শহরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদা দিলে মাঈনুদ্দিন খোন্দকার, মাহবুবুর রহমান ও আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাঁদের দুজনের ডিউটি ছিল শহরের বিভিন্ন এলাকায়। আমার ডিউটি সহজ, পুলিশ সদর দপ্তর, লালদিঘীর পাড়ে। দুপুর পর্যন্ত আরামেই ছিলাম, দুপুরের পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। আমাকে বের হতে হয় সদরের নিরাপত্তা থেকে রাস্তায়। সংগে ছিল এক ট্রাক বিডিআর (অধুনা বিজিবি)। পুলিশ সদর থেকে বের হয়ে কোতোয়ালী থানার দিকে আসতে থাকি। আমার ট্রাকের সংগে আসতে থাকে জামাতের তৎকালীন এমপি শাহজাহান চৌধুরী’র নেতৃত্বে এক কর্মী বাহিনী। আমি বার বার বলছি যে আপনারা আসলে আমি আগাবো না, তাও তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছিল না। আমি এসে পৌঁছালাম কোতয়ালী থানার সামনে। উল্টোদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভবন। আর নিউমার্কেটের দিক থেকে আসা রাস্তায় শুকতারা হোটেলের সামনে থেকে ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুদিক থেকে গুলি বিনিময় শুরু হল। আমার চোখের সামনে সিডিএ ভবনের দেয়ালের পাশ থেকে এক যুবক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ছাত্রলীগের মিছিলের দিকে গুলি ছুড়ছে। আমার চোখের সামনেই একাধিক আহত ও নিহতদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি প্রলুব্ধ হচ্ছিলাম বিডিআরকে বলতে ‘টু শুট দ্যাট ইয়ং ম্যান”। তবে এরকম শুটিং অর্ডার দেয়াও কঠিন। আমি বিডিআরকে ফায়ারিং অর্ডার দিলাম। এমন সময় আমার জীপের দরজায় এসে একটা গুলি লাগলো। আবার আমি ছিলাম ‘ক্লোজ টু ডেথ’। থানার গেট থেকে এক পুলিশ পরিদর্শক দৌড়ে আসলো, আমার তখন চট্টগ্রামে এমএম হিসাবে সাড়ে তিন বছর, পুলিশের সবাই আমাকে চেনে। আমাকে বলতে গেলে ধমক দিয়ে জীপ থেকে নামিয়ে থানার ভেতরে নিরাপত্তায় নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখি সেখানে হেলমেট পরা ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সৈয়দ বজলুল করিম ও অন্য একজন ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সম্ভবত সুলতান আহমেদ। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলাগুলির তীব্রতা কমে আসে। আমি সবসময়ই গোলাম আজমের ঐ জনসভার সময় এই দায়িত্ব পালনের জন্য একটা লজ্জাবোধে ভুগেছি, বাট দ্যাট ওয়াজ ডিউটি। আর ঐ যুবকের সংগে কিছুদিন পরেই আমার কোর্ট চেম্বারে দেখা হয়েছিল, সে অন্য গল্প।