জালাল আহমেদ
চট্টগ্রাম শহরে আমার ছোটবেলা কেটেছে ॥ সেই চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলাম
আমার দীর্ঘ চাকুরী জীবনে আমি কখনোই কোন নির্দিষ্ট পদে পদায়নের জন্য আগ্রহী ছিলাম না, সে চেষ্টাও কখনো করি নাই। এক্ষেত্রেও তাই। ঢাকার মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন, তা আমি জানতাম। এতে কখনো কখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত জানাশুনা গুরুত্ব পায়। আমার ক্ষেত্রে ভরসা ছিলেন ডেস্ক অফিসার ইকরাম আহমেদ। উপসচিব (মাঠ প্রশাসন)ও আমার উপর খুশী ছিলেন না কারণ আমি তাঁর সাথে দেখা করে অনুরোধ করি নাই। যাই হোক, আমার জায়গায় আমার ব্যাচমেট কাওসার জহুরা’র নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে চারজনের ঢাকায় পদায়নের আদেশ হল। পরদিন সচিবালয়ে আসলে ইকরাম ভাই আমাকে বললেন যে তিনি আমাকে চট্টগ্রাম অথবা খুলনা দেবার চেষ্টা করতে পারেন। আমি চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকেই ঢাকা এসেছিলাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরী শুরু করেছি আর জীবনের প্রথম ৭ বছর কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। তাই বললাম যে চট্টগ্রামে দেবার চেষ্টা করতে পারেন। এইভাবে আমার মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট চট্টগ্রাম হিসাবে পদায়নের আদেশ হল।
আমি ২০ জানুয়ারি ১৯৯১ তারিখে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে যোগদান করি। ঐ সময়েই মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের পদকে সিনিয়র স্কেল করা হয় এবং চট্টগ্রামে আমিই প্রথম সিনিয়র স্কেল মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট। এর আগে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে কর্মকর্তারা ইউএনও হিসাবে বদলী হয়ে যেতেন আর আমি ইউএনও হিসাবে কাজ করার পর এই পদে এলাম। তখন চীফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট চট্টগ্রাম ছিলেন জি এস ধর, গোকুলানন্দ সুত্রধর, মানিকগঞ্জ এর লোক। এম এম ছিলেন বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের প্রকাশ চন্দ্র দাস ও পরীক্ষিৎ দত্ত চৌধুরী।
আমার স্ত্রীর মামা নুর মোহাম্মদ ছিলেন ১৯৬৩ সালের সিএসএস, পোস্টাল সার্ভিসের কর্মকর্তা। তিনি ১৯৮৩ সালে যুগ্মসচিব হলেও সরকার তাঁকে অতিরিক্ত সচিব করে নাই। একই আদেশে যুগ্মসচিব হওয়া অন্য কর্মকর্তাগণ অতিরিক্ত সচিব হলে তিনি অত্যন্ত শকড হন। এরপর সরকার তাঁকে তাঁর পুরনো দপ্তর ডাক বিভাগের মহাপরিচালক পদে পদায়ন করে। আমি চট্টগ্রাম যাবার আগে ১৮ বা ১৯ জানুয়ারি তাঁর সংগে দেখা করতে গিয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমাকে প্রথমে চিনতে পারেননি। ভালো করে পরিচয় দেবার পর চিনতে পারলেন। ২৬ জানুয়ারি খবর পাই যে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং তিনি হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তখন বুঝতে পারি যে হয়তো আগে থেকেই তাঁর শারীরিক সমস্যা শুরু হয়েছিল। আমি খবর পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে আসি এবং তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাই। ঐদিন রাতেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কথা আমার সবসময়ই মনে হয়। তিনি অত্যন্ত সুদর্শন এবং সৌখিন লোক ছিলেন। উত্তরার ৭ নং সেক্টরে তাঁর ৭.৫ কাঠার প্লট ছিল এবং সেখানে তিনতলা এক ইউনিটের বাড়ি বানিয়ে প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। এই বাড়ির ফিটিং ফিক্সিং অনেক কিছুই তিনি নিজে পছন্দ করে বিদেশ থেকে এনেছিলেন। আমরা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে ঐ বাড়িতে যাই। আর এক মাস পরেই হয়তো তিনি ঐ বাড়িতে উঠতে পারতেন। জীবনের এই অনিশ্চয়তা এবং তাঁর এই মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়।
আমি চট্টগ্রামে এসে উঠেছিলাম আমার মামাতো বোন মমতা আপার বাসায়। দুলাভাই তখন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ। লালখান বাজার কলোনীতে পুরনো তিন ভবনের একটির নীচতলায় তিনি থাকতেন। বাঁশখালীর হারুনুর রশিদ চৌধুরী, যিনি বড় ঠিকাদার ছিলেন তাঁর ছেলে আনোয়ারুল হাকিম চৌধুরী আরজু আমার পরিচিত ছিলেন। নুর আহমদ সড়কে তাঁদের একটি কনসাল্টিং ফার্ম ছিল হিরামন এসোসিয়েটস নামে। আরজু ভাই চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুলে আমার সম্মন্ধী এজাজ হোসেন খান এর ক্লাসমেট, বাঁশখালীতে আমার অফিস সুপার রাশেদ আহমদ চৌধুরী’র ভাগ্নে। আরজু ভাইকে একটা বাসা খুঁজে দেবার কথা বলাতে তিনি পারসিভিল হিলে তাঁদের পাশের বিল্ডিং এর নীচতলার একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান দিলেন। দেখে পছন্দ হলে নুরুল ইসলাম সওদাগর এর বিল্ডিংয়ে ঐ ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নিলাম। আজিমপুর কলোনীর ৬/বি বাসা ছেড়ে আমরা আবার চট্টগ্রামের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। ইতোপূর্বে উল্লিখিত আমার দু’স্টেশনের এডিসি আফজাল স্যার তখনো চট্টগ্রামে, স্টেডিয়াম এর পাশের এক সরকারী ভবনে থাকেন। ফলে আমাদের পারিবারিক বেড়ানোর একটা জায়গাও আছে। আমার বন্ধু সোলায়মান এর বাসাও কাছেই, চকবাজারে, প্যারেড ময়দানের উত্তরপূর্ব কোনে। সবচেয়ে বড় কথা ছিল আরজু ভাইয়েরা ছিলেন প্রতিবেশি এবং তাঁরা আত্মীয়-পরিজন এর চেয়ে কোন অর্থেই কম ছিলেন না। পারসিভিল হিলের উপরে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন এবং শিক্ষকদের বাসভবনও ওখানেই। আমি আগে একস্থানে উল্লেখ করেছি যে এখানেই আমার এক খালুর বাসায় আমি থেকেছি যিনি চট্টগ্রাম কলেজে রসায়নের শিক্ষক ছিলেন।
মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেসী হল আমার ভাষায় ‘পিউর ম্যাজিস্ট্রেসি’। আমরা যখন জেলা প্রশাসনে কাজ করেছি তখন ম্যাজিস্ট্রেসি ছাড়াও ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ’, অনেক কিছুই করেছি। এমন কি উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমি সহকারী কমিশনার (অর্থ) এর দায়িত্ব পালন করেছি। তবে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর দায়িত্বও পুরোপুরি ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব। আমি উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম দুই উপজেলায় আড়াই বছর। এই অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগলো। আগেই উল্লেখ করেছি যে চট্টগ্রাম শহরে আমার ছোটবেলা কেটেছে, তখন দু’একবার কোর্ট হিল, যা পরীর পাহাড় বা ফেইরী হিলস নামে খ্যাত, দেখতে এসেছি। এখান থেকে কর্ণফুলী পরিষ্কার ভাবে দেখা যেত, দেখা যেত সমুদ্রও। সেই পরীর পাহাড়ে কাজ করার অনুভূতি ছিল আলাদা। তখন বিভাগীয় কমিশনার ওমর ফারুক, ১৯৭০ ব্যাচের সিএসপি, জেলা প্রশাসক ছিলেন একই ব্যাচের ইপিসিএস আব্দুর রব খান, এ আর খান নামে যিনি পরিচিত ছিলেন।
মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কিছুদিন কাজ না করতেই আমাদের সিএমএম জিএস ধর বদলী হয়ে গেলেন আসলেন অত্যন্ত আনইম্প্রেসিভ দেখতে এস এম মতিউর রহমান। মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান ছিলেন ১৯৬৮ ব্যাচের ইপিসিএস-২, যিনি সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) হিসাবে একটি থানাতেই কাজ করেছেন, যে থানা ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তাঞ্চল, তেঁতুলিয়া। আমি যেমন একটি উপজেলাতেই নির্বাহী অফিসার, আমার বন্ধুরা ২/৩/৪ টি উপজেলাতেও নির্বাহী অফিসার ছিল, সেই সময়টা আমার কেটেছে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেসিতে। মতিউর রহমান সাহেবের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামে, যে গ্রামে সৈয়দ শামসুল হক এরও পৈত্রিক বাড়ি। শ্বশুর ছিলেন মুজিবুর রহমান, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের অফিসার। ১৯৭১ সালে তেঁতুলিয়া মুক্তাঞ্চল থাকাতে তিনি তেঁতুলিয়াতেই ছিলেন, চাকুরীও করেছেন সেখানেই। আগস্ট মাসে কলকাতা গিয়েছিলেন বলে আমাদের বলেছেন। বেতন নিয়েছেন মুজিবনগর সরকারের। যখন সিও ছিলেন তখন তেঁতুলিয়া থানা’র অফিসার ইনচার্জ ছিলেন আব্দুর রশিদ, স্মার্ট, আইন জানা এক পুলিশ অফিসার। আইনের কোন প্রসঙ্গ আসলেই তিনি আইনের ধারা, সিআরপিসি, বিপিসি বা পিআরবি উল্লেখ করে কথা বলতেন। এতে সিও সাহেব যেতেন ঘাবড়ে! তিনি তাঁর শ্বশুরকে এই বিষয়টা বললেন। শ্বশুর তাকে রতনলাল এর সিআরপিসি কিনে দিলেন এবং তা’ পড়তে ও টেবিলে রাখতে বলে দিলেন। তারপর থেকে তিনি টেবিলে সিআরপিসি রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন, রশিদ ভীতিও কেটে গেল আর জীবনে এই অভ্যাস বদলাননি। এটি ছিল একটি বড় শিক্ষা। মতিউর রহমান সাহেবের মেয়ের জামাই ছিল আমাদের ব্যাচমেট আইনুল ফরহাদ।
পরে আমি যখন এডিসি নোয়াখালী এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবের একান্ত সচিব তখনো আমার টেবিলে এই ফৌজদারী কার্যবিধি থাকতো এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে ম্যাজিস্ট্রেটরা আমার পরামর্শ চাইলে তাৎক্ষণিক তা দিতে পারতাম।