জালাল আহমেদ
ঠিকাদাররা মিলে মিশে বিভিন্ন কাজের জন্য তিনটি করে দরপত্র জমা দেয় এবং মূলতঃ কয়েকজন মিলে কাজগুলো করে
পুরো উপজেলা ঘুরে আসার ফলে একটা বড় উপকার পাওয়া গেলো ‘মন ছবি’ তৈরি হয়ে যাওয়া। এখন যে কেউ যে কোন এলাকার উল্লেখ করুক আমি ল্যান্ডমার্ক বা রেফারেন্সগুলো বুঝতে পারছিলাম। একটা বিষয় চোখে পড়লো যে সারা উপজেলা জুড়ে প্রতি বাজারেই একাধিক স্থানে কিশোর-যুবকদের ক্যারাম বোর্ড খেলা চলে এবং এই খেলা হত টাকার বিনিময়ে। একধরনের নির্দোষ জুয়া, বাজি রেখে খেলা, যাতে কেউ মনে কিছু করে না। আমি কোন খেলায়ই খুব ভালো না হলেও সব খেলাই খেলতে পারি যা আগে উল্লেখ করেছি। যে স্টেশন থেকে এসেছি সেই চাঁদপুরেও টেনিস, টেবলটেনিস, ব্যাডমিন্টন, স্কোয়াশ ও বিলিয়ার্ড খেলতাম। ফলে খেলাধুলার প্রতি একটা আকর্ষণও ছিল। নিজে কখনো কখনো ক্রিকেট খেলেছি আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ১৯৭৬ থেকে শুরু করে এখনো অনুসরণ করি। এরমাঝেই পরিচয় হল উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারী হিমাংশু বিমল ভট্টাচার্যের সংগে। তাঁর কাছ থেকেই শুনলাম যে এই উপজেলায় কখনো ফুটবল লীগ হয় নাই। ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়েছে, কিন্তু বার্ষিক লীগ নয়। সবার সংগে কথা বলা শুরু করলাম লীগ আয়োজনের সম্ভাবনা নিয়ে। বিভিন্ন মত আসতে লাগলো, পক্ষে এবং বিপক্ষে। অধিকাংশই সংশয়াকুল, যে এটা সম্ভব হবে কি না। এমন কি স্থানীয় সংসদ সদস্যও বললেন যে এটা পারা যাবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে একটা চেষ্টা করি না কেন!
উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে প্রথম বাঁশখালী উপজেলা ফুটবল লীগ আয়োজন করা হল এবং কোন বিঘœ ছাড়াই তা’ এগুতে লাগলো। সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় নেতৃত্ব ও আন্তরিক সহযোগিতা করে। স্থানীয় সম্ভাব্য বিঘœ সৃষ্টিকারীদের সবাইকে স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম যা ফরিদ্গঞ্জেও ভালো কাজ দিয়েছিল। সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলায় টিকেট বিক্রির পদক্ষেপও নেয়া হল। ফাইনাল খেলায় ৫ টাকা করে ৩৫ হাজার টাকার টিকেট বিক্রি হল। টিকেট বিক্রির টাকা মূলতঃ স্বেচ্ছাসেবকদের ভাতা হিসেবে দেয়া হল। সাফল্যের সংগে আমরা লীগ শেষ করতে সমর্থ হই এবং পুরো উপজেলায় এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফাইনাল খেলা শেষে এক বিরাট নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। সংসদ সদস্য সাহেব উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিও সাফল্যের সংগে একটি ফুটবল লীগ শেষ করতে পারায় একটু অবাক হন। ক্যারাম খেলা কিছুটা কমে আসে, বিভিন্ন ইউনিয়নে ফুটবল খেলা বেড়ে যায় এবং এর প্রভাব শীতকালীন খেলাধুলার উপরেও পড়ে। পুরো উপজেলাতেই একটা সাড়া পড়ে যায়। ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টস শুরু হয়।
বাঁশখালী উপজেলা সম্পদে ভরপুর একথা আমি আগেও বলেছি। এর উর্বর জমি চাষের জন্য ছড়ার পানি সেচের একটি বড় উৎস। শীতকালে ছড়ার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে গ্র্যাভিটি ফ্লোর মাধ্যমে সেচের কাজ চালানো হত। প্রতি বৎসরই এই সেচের পানির ভাগাভাগি নিয়ে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি ও মারামারি হত। জলদী উপজেলা সদরের দক্ষিণে শিলকূপ ইউনিয়ন, চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম জাসদের রাজনীতি করতেন। পনেরো চেয়ারম্যানের মধ্যে সবচেয়ে অসচ্ছল কিন্তু জনপ্রিয়। তাঁর এলাকায় চাষের পানির জন্য শিলকূপ ছড়ার উপর নির্ভরশীলতা ছিল অনেক বেশি এবং পূর্ববর্তী কোন কোন বছরে সেখানে সেচের পানি নিয়ে খুনখারাবীও হয়েছে। প্রতিবছর শীতে সেখানে ছড়ায় বাঁধ দেয়া হত। উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি সিকদার প্রস্তাব করলেন যে স্থায়ী কিছু করা যায় কিনা যাতে করে এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানও হয়। এটি একটি অত্যন্ত জনকল্যাণমুখী চিন্তা ছিল। তখন বর্ষার শেষ, সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিজে দেখতে যাবো জায়গাটি।
পরদিন সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। আমি তখনো শিকার করি, আমার খাকী এবং জলপাই ড্রেস ছিল শিকারের, ছিল জুতোও। শিকারের পোষাক পড়ে রাইফেল নিয়ে সকালবেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল বাশারসহ তুমুল বৃষ্টির মধ্যে গাড়িতে শিলকূপ ছড়া পর্যন্ত যাই। এরপর ছড়ার পাড় ধরে পূবের পাহাড়ের দিকে যাত্রা। বৃষ্টিতে ছড়ার পাড় একদম পিচ্ছিল, কিছুদুর হাঁটার পর খাগড়াছড়িতে কাজ করার পাহাড়ি অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম, ছড়ার উপর দিয়ে হাঁটা। পানি কোথাও কোথাও কোমর ছুঁই ছুঁই, আর বৃষ্টি পড়ছে সমানে। এরমাঝেই পাহাড় পর্যন্ত চলে গেলাম। সেখানে ছড়া দু’টো, বামের ছড়া আর ডানের ছড়া, যেখানে বামের ছড়ার উপর অস্থায়ী বাঁধ আছে তার উজানে ডানের ছড়া এসে বামের ছড়ায় পড়েছে। বৃষ্টির পানি অস্থায়ী বাঁধ উপচে শিলকূপ ছড়ায় পড়ছে। আমার কাছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উপযোগী এবং জনসাধারণের জন্যও উপকারী হবে বলে মনে হল। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী’র বরাদ্দ দিয়ে সেই যাত্রা শুরু বামের ছড়া প্রকল্পের যাকে এখন সবাই বাঁশখালী ইকো পার্ক নামে চিনে। এখন চট্টগ্রাম থেকে পর্যটকরা আনোয়ারা হয়ে সরাসরি বাঁশখালি ইকোপার্কে চলে যেতে পারেন এর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য। আমি ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন সস্ত্রীক বাঁশখালী গিয়েছিলাম তখন বাঁধসৃষ্ট লেকে নৌকা নিয়ে ঘুরে এসেছি। পরে ২০১৯ সালেও আবার বাঁশখালী ঘুরে এসেছি। শঙ্খ নদীর উপর সেতুর কারনে এখন চট্টগ্রাম শহর থেকে অল্পায়াসেই বাঁশখালী ঘুরে আসা যায়।
ইতোমধ্যে নতুন অর্থ বছরের বরাদ্দ আসলে উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রকল্প নির্বাচন, প্রকল্প বাছাই, প্রকল্প প্রনয়নের কাজ শুরু হয়। উপজেলা পরিষদের বার্ষিক বরাদ্দের খাতওয়ারী বিভাজন ছিল এবং বিভাজনের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমাও ছিল। পরিষদ সদস্যদের স্বভাবতই চেষ্টা ছিল নির্মাণে যত বেশি বরাদ্দ নেয়া যায়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে টাকা বরাদ্দে সবাই ছিল কৃপণ। আমার চেষ্টা ছিল অন্ততঃ যে ধরণের প্রকল্প তুলে আনা যায় সে ধরণের প্রকল্প নেয়া। নীতিমালা অনুসরণ করে সকলের সম্মতিতে উপজেলা পরিষদের সভায় প্রকল্প তালিকা অনুমোদিত হয়। এখনো যখন পেছনে ফিরে তাকাই এটা অনুধাবন করে তৃপ্তি পাই যে সাধারণভাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সংগে আমার বড় ধরণের কোন মতানৈক্য হয় নাই। আর একটি প্রকল্প সবাইকে প্রভাবিত করে আমি নিতে সমর্থ হই তা হল উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা ও স্কাউট ভবন। উপজেলা কমপ্লেক্স এর এক কোনাতে, প্রধান সড়কের পাশে এর জন্য স্থানও নির্ধারিত হয়। আর জলকদর খালের উপর মোশাররফ মিয়া’র হাটের সেই সেতুর পাটাতন মেরামত করা যাতে করে বাহারছড়া সি বীচে শীতকালে উপজেলা পরিষদের পিকনিক করা যায়।
সমস্যা হল ঠিকাদারদের নিয়ে। বাঁশখালী উপজেলায় ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ যথারীতি সংসদ সদস্যের হাতে, উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যানের শ্যালক রাখাল বাবু এবং একজন ঠিকাদার কাম অধ্যাপক ইদ্রিস এর হাতে। ঠিকাদাররা মিলে মিশে বিভিন্ন কাজের জন্য তিনটি করে দরপত্র জমা দেয় এবং মূলতঃ কয়েকজন মিলে কাজগুলো করে। তখন উপজেলা প্রকৌশলী ছিলেন রেজাউল করিম নামে একজন বয়স্ক পদোন্নতি প্রাপ্ত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। তাঁর নিষ্ঠা এবং আনুগত্য নিয়ে সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিয়ে এবং যেহেতু বেশ কিছুদিন ধরেই ওখানে ছিলেন ফলে স্থানীয়দের সংগে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। আমি এটা বুঝতে দিলাম যে বোঝাপড়ার কাজ আমার সংগে হবে না। ফলে যখন কাজের শিডিউল বিক্রি শুরু হল তখন প্রতি কাজেই ২০ থেকে ৩০টা পর্যন্ত শিডিউল বিক্রি হল, যা ছিল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। যখন প্রতি কাজে ১৮ থেকে ২৪টা শিডিউল জমা পড়ল তখনো ভাবছি যে সব ঠিকঠাক। যখন শিডিউলগুলো খোলা হল তখন দেখা গেল তাঁদের স্মার্টনেস, সবাই একদর! আমাকে ঐদিন সই দিতে হল ৫০০ এর কাছাকছি এবং আয়োজন করা হল লটারীর। লটারীর ঝুঁকি প্রতিফলিত হল ফলে, নতুন কিছু ঠিকাদার কাজ পেল যা উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। কিন্তু একজন নতুন ও সামর্থ্যহীন ঠিকাদার ৪টি কাজ পেয়ে আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন। আর চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর কাজ যেন অন্যরা নিয়ে যেতে না পারে।