জালাল আহমেদ
আলী হায়দার খান ছিলেন ‘ওয়ান অফ দ্য ওল্ড গার্ডস’, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ॥ দুঃখজনক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর এক মাসের জন্য স্ত্রীও মারা যান

২৯ এপ্রিল ও ১ মে, ১৯৮৬ এই দু’দিনের ঘটনায় স্থিতিশীল পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। জোড়াতালি দিয়ে যা হোক কিছু একটা চলছিল, এতে এই ফ্যাব্রিকটাও আর থাকলো না। আবার শুরু করতে হবে স্কোয়ার ওয়ান থেকে। এই ঘটনায় নতুন করে প্রায় ৫০ হাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ভারতে শরণার্থী হয়। উপজেলা সদরেও অস্বাভাবিক অবস্থা, বিভিন্ন অফিসের স্থানীয় কর্মচারীগণ কেউ অফিসে আসছেন, কেউ শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গিয়েছেন। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের অনেকেই চলে গিয়েছেন, স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীও নেই। এক বিধ্বস্ত পরিবেশ সর্বত্র বিরাজমান, বাস্তবে এবং মনোজগতেও। এর কয়েকদিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে আমার বদলীর আদেশ চলে আসলো। ১৪ মে ১৯৮৬ বিভাগীয় কমিশনারের আদেশ পেলাম যে আমাকে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় বদলী করা হয়েছে। ততদিনে পানছড়ি’র রাস্তা পাকা করার কাজ শুরু হয়েছে আর ফরিদগঞ্জ উপজেলার রাস্তা তখনো কাঁচা! উপজেলা সদরে সবাই বলতে শুরু করলো যে কমিশনার সাহেব নিশ্চিত আপনার আত্মীয় হয় নইলে এইরকম নিদারুন সময়ে পানছড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়! পার্বত্য জেলাসমূহে বিধান ছিল যে কোন কর্মকর্তাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তা যোগদান না করলে অবমুক্ত করা যাবে না। আমার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হল, কমিশনার অফিস থেকে টেলিগ্রাম আসল আমাকে ছেড়ে দিতে।
আমি তো জানতাম যে আমি যেতে পারবো না, ঐদিন ১৮ মে আমি জেলা সদরে এক মিটিং এ গিয়েছি, অতিরিক্ত কমিশনার জেলা প্রশাসককে ফোন করে বললেন আমাকে ছেড়ে দিতে। সভাশেষে আমার বিদায় সংবর্ধনাও হয়ে গেল। উপজেলায় ফিরে এসে প্রস্তুতি নিলাম, পরদিন ১৯ মে চট্টগ্রামে চলে এলাম। আমার আসবাবপত্র, বই সব রেখে বহনযোগ্য সামগ্রী নিয়েই আমি চলে এলাম চট্টগ্রাম পুরনো সার্কিট হাউসে। আমরা সবাই জানি ১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে এই সার্কিট হাউসে হত্যা করা হয়। তারপর দীর্ঘদিন এই সার্কিট হাউস বন্ধ ছিল। তখন ১৯৮৬ সনে নতুন করে আবাসন সুবিধা মাত্র চালু হয়েছে। সন্ধ্যায় ফিনলে হিল এর কাছে কমিশনার বাংলোতে গেলাম। ডিসি হিলের উপরের পুরনো বিভাগীয় কমিশনার বাংলো তখন বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় বিভাগীয় কমিশনার কিছুদিন হয় এখানে বসবাস করছেন। এই বাসভবনটি সম্ভবত এখন সহকারী কমিশনার (ভূমি) চট্টগ্রাম এর অফিস। তখন বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন আলী হায়দার খান, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাক্তন কিংবদন্তী জেলা প্রশাসক। আমি বিশাল ড্রয়িং রুমে বসলাম, কমিশনার সাহেব একটু পর দোতলা থেকে নেমে আসলেন, সিঁড়ি থেকেই বললেন যে, কি জালাল, মন খারাপ নাকি? আমি বললাম না স্যার, আমি রিলিজ নিয়ে রেডি হয়েই এসেছি, তবে এক কাঁচা রাস্তা থেকে আরেক কাঁচা রাস্তা! তিনি বললেন যে পরদিন তিনিও চাঁদপুর যাচ্ছেন, আমি তাঁর সংগেই যেতে পারতাম তবে তিনি যাবার পথে চান্দিনাতে তাঁর মেয়েকে দেখে যাবেন তাই নিতে পারছেন না, আমার সঙ্গে চাঁদপুরে দেখা হবে।
আমি বিদায় নিয়ে সার্কিট হাউসে আসলাম। পরদিন ট্রেনে লাকসাম হয়ে চাঁদপুর যাই। চাঁদপুর শহরে দুটো স্টেশন, কোর্ট স্টেশন ও বড় স্টেশন। কোর্ট স্টেশন স্বভাবতই কোর্ট কাচারী সংলগ্ন, বড় স্টেশন চাঁদপুর নদী বন্দরে ও বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। চাঁদপুর পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো। কোর্ট স্টেশনে নেমে অপেক্ষমান মিনিমোক গাড়ি পাই এবং গাড়ি করে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আসি। চাঁদপুরে তখনো সার্কিট হাউস হয়নি বলে জানতে পারি এবং বিভাগীয় কমিশনারও একটু পর এখানেই আসবেন। কেয়ারটেকার প্রকাশ বললো যে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উপরে আছেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে বাংলোর দোতলায় যাই, বারান্দা ধরে এগিয়ে সামনে খোলা টেরাসের দিকে এগোই, মাথায় ক্যাপ ও হাতে রাইফেল। দু’জনকে বসা রেখে উঠে আসেন একজন, আমি সালাম দেই তিনজনকেই, যিনি এগিয়ে আসেন পরিচয় দেন মোঃ আফজাল হোসাইন বলে, এডিসি (জেনারেল)। পরিচয় হয় জেলা প্রশাসক, আমার দেখা একজন সেরা মাঠ কর্মকর্তা এস এম শামসুল আলম এবং সবসময় হাসি খুশী পুলিশ সুপার ইফতেখার উদ্দিন আহমদ এর সঙ্গে। এডিসি স্যার বলেন যে বিভাগীয় কমিশনার এসে পৌঁছাবেন এখনই, স্যার আমার সঙ্গে ২০৫ নং রুম পর্যন্ত আসেন। আমি সেটেলড হই, দ্রুত গোসল সেরে বিভাগীয় কমিশনার সাহেব আসার আগেই প্রেজেন্টেশন লাইনে (পরিচিতির জন্য লাইন) দাঁড়িয়ে পড়ি।
বিভাগীয় কমিশনার দুদিন ছিলেন, দু’দিনের সব প্রোগ্রামে আমি ও ছিলাম। তাম্বুরা (হাউজি) খেলাও হয়। আলি হায়দার খান তখন যেখানে যেতেন ইন হাউস তাম্বুরা খেলা হতো, আর তিনি সব সময় ভাবিসহ ট্যুর করতেন। দু’দিন অফিসিয়াল কাজ শেষে বিভাগীয় কমিশনারের যাবার সময়, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সবাই বিদায়ী লাইনে। তিনি জেলা প্রশাসককে বললেন “জালাল ভালো অফিসার, আপনার কাছেই রেখে গেলাম”, আর আমাকে বললেন তুমি এখানেই থাকো। এর কোন কারণ জানি না কিন্তু উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে বদলীর আজ্ঞাধীন অফিসার আমি কোন আদেশ ব্যাতিরেকেই জেলা সদরে রয়ে গেলাম। আলী হায়দার খান ছিলেন ‘ওয়ান অফ দ্য ওল্ড গার্ডস’, পুরনো যুগের অফিসারদের মত, একটা দরবারী ভাব ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি ছিলেন আন্তরিক ও এপ্রোচেবল। যে কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা ছিল। একজন অফিসারের জন্য এটা ছিল বিশাল অর্জন। আট বছর ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (চার বছর অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবানসহ), চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং বিভাগীয় কমিশনারও পার্বত্য চট্টগ্রাম এর জন্যই। এর আগে ১৯৫৮-৬৩ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সহকারী পুনর্বাসন কর্মকর্তা, ১৯৬৩-৭৩ ইন্টার-উইং ট্রান্সফারে পশ্চিম পাকিস্তানে, ফিরে আসার পর ১৯৭৪ সালে ছিলেন এডিসি পাবনা, এর পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। অবসরে যাবার অল্প কিছুদিন পরই কুমিল্লার কাছে দুঃখজনক এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি মারা যান। এক মাসের মধ্যে তাঁর স্ত্রীও মৃত্যুবরণ করেন।