জালাল আহমেদ
আব্বা এবং আমি দু’জনেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম!
বাবা-ছেলে একসঙ্গে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি এটাও মজার ছিল

এদিকে তখন দেশে সামরিক শাসন ভালো করেই জেঁকে বসেছে এবং সামরিক শাসকদের যা পদ্ধতি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন কিছু করে শো অফ এর বিভিন্ন চেষ্টা চলছে। তারমধ্যে অন্যতম ছিল স্থানীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন। ১৮৭০ সালের চৌকিদারী পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বা ১৮৮৫ সালের স্থানীয় সরকার আইনের কথা বিবেচনা করলে ইউনিয়ন পরিষদ, সেটা যে নামেই ডাকা হোক, তখন শতাব্দী প্রাচীন। ইউনিয়ন পরিষদের উপরের স্তরে কখনো আমাদের নির্বাচিত স্থানীয় সরকার ছিল না, সামরিক শাসক মানোন্নীত থানা পরিষদ নাম দিয়ে নির্বাচিত চেয়ারম্যান এর এক পদ্ধতি নিয়ে আসলো। এই থানা পরিষদই পরে উপজেলা পরিষদে রুপান্তরিত হয়। প্রথম তিন বছর উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণই চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসক এরশাদের শ্লোগান ছিল প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। এর মাধ্যমে তিনি প্রথমে মানোন্নীত থানা করলেন, পরে উপজেলা নাম দিলেন। এর প্রধান ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। সেখানে কিছু বিষয় ছিল পরিষদে হস্তান্তরিত আর কিছু সংরক্ষিত। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিন্তু সংরক্ষিত বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন জেলা প্রশাসকের অধীন। অন্যতম যে পরিবর্তন হয় তা হলো উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তর। ফৌজদারী ও দেওয়ানী আদালত উপজেলা পর্যায়ে চলে যায়।
প্রথমদিকে আইনজীবী ও অন্য অনেকের জন্য এটা একটা শকের মতো ছিল কিন্তু পরে দেখা যায় যে উপজেলা টাউনশীপ গড়ে তোলার জন্য এটা ছিল অপরিহার্য। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে প্রথম পর্যায়ের ৪৫টি থানা মানোন্নীত হয়, তাঁর পরের দফায় ৫৫টি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের পদ ছিল মহকুমা প্রশাসকের এক ধাপ উপরে ফলে অনেক এসডিওই পদোন্নতি পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে পদায়িত হন। ঢাকা সিটি’র মহকুমা প্রশাসকের পদায়ন হয় তখন অন্যতম দুর্গম উপজেলা চট্টগ্রামের বাঁশখালী’র নির্বাহী অফিসার পদে। এই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে উপজেলা পর্যায়ে ক্রমশঃ শহর গড়ে উঠতে থাকে। উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতা কাঠামো এবং ক্ষমতা বলয়েও পরিবর্তন আসে। যে কারণে সংসদ সদস্যগণ কখনো এই পদ্ধতিকে মনেপ্রাণে গ্রহন করতে পারেন নাই। বিশেষ করে ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পর উপজেলা চেয়ারম্যানগণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েও হস্তান্তরিত বিষয়সমূহে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পান।
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল বিচারকের পদ সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। এই পদ পূরণ হবে কোথা থেকে? তখনই কেউ কেউ বিশেষ পরীক্ষার ধারনা নিয়ে হাজির হন যা গ্রহন করা হয়। এজন্য বিসিএস রিক্রুটমেন্ট রুলস ১৯৮১ তে সংশোধনীও আনতে হয়। ২২ ডিসেম্বর ১৯৮২ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (প্রশাসনিকঃ প্রশাসনিক) ৬৫০টি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ (বিসিএস নিয়োগ বিধি ১৯৮১ অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডারের প্রবেশ পদ এসিস্ট্যান্ট কমিশনার) বিজ্ঞপ্তি জারী করে। বয়ঃসীমা রাখা হয় ২১-৫০ এবং বেতন নির্ধারণ করা হয় বয়স ভিত্তিক, যার বয়স যতো বেশি তার বেতন ততো বেশি। ১৭ জানুয়ারী ১৯৮৩ ইত্তেফাক রিপোর্ট করে যে “মেজিস্ট্রেট পদের জন্য ২৮০০০ প্রার্থী”। বয়ঃসীমা বেশি থাকায় বিভিন্ন পেশার লোকজন এখানে আবেদন করতে শুরু করেন। এ নিয়ে পরে প্রচুর সমালোচনা হলেও তখন করার কিছু ছিল না।
আমি দরখাস্ত করতে খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না কারণ আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষায় আমি পাশ করবো। এর মাঝে আব্বা আগ্রহী হলেন দরখাস্ত করতে। এখানে একাধিক কারণ ছিল আব্বার আগ্রহের। আব্বা ১৯৬১ সালে সিএসএস পরীক্ষায় অংশ নেন যার ফলাফলের বই আমাদের বাসায় ছিল। এতে ফলাফল ছিল তিন ধাপে, “পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং নিয়োগের যোগ্য”, “পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু নিয়োগের যোগ্য নয়” এবং “পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ”। তিনি পরীক্ষায় পাশ করলেও পদ সংখ্যা কম হওয়ায় নিয়োগের যোগ্য হন নাই। ১৯৬২ তেও উনার ভাগ্যে তাই ঘটে। ফলে এইবার সুযোগ পেয়ে তিনি ভাবলেন যে পরীক্ষা দিবেন। তখন উনার বয়স ৪৬, আইনে স্নাতক এবং হবিগঞ্জে আইন পেশায় নিয়োজিত। আইনে স্নাতকদের জন্য দুটো বাড়তি ইনক্রিমেন্ট থাকায় তাঁর সম্ভাব্য বেতনও ছিল সিনিয়র স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে। অন্য কারণটি সম্ভবতঃ ছিল থানা/উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তর। আব্বা ১৯৭২-১৯৮২ সময়কালে হবিগঞ্জের সর্বাধিক ব্যস্ত ফৌজদারী আইনজীবীদের একজন ছিলেন। তিনি প্র্যাকটিস করতেন নিম্ন আদালতে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো সব স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়াতে তাঁর প্র্যাকটিসে ভাটা পড়ে। তিনি দায়রা আদালতে প্র্যাকটিস শুরু করলেন একই সঙ্গে তিনি ভাবলেন এই বিকল্পটা পরীক্ষা করি! তখন আমি ও আব্বা দু’জনেই আবেদন করলাম। ১৯ ফেব্রুয়ারী মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। আমার সিট পড়ে ঢাকা কলেজে আর আব্বার সিট পড়ে তেজগাঁও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। বাবা-ছেলে একসঙ্গে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি এটাও মজার ছিল। আব্বা পড়ুয়া ছিলেন বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইন পর্যন্ত মনযোগ দিয়ে পড়তেন এবং তিনি ছিলেন স্পীড রিডার, দ্রুত পড়তে পারতেন, যে গুন আমিও কিছুটা পেয়েছিলাম। ফলে আব্বার প্রস্তুতি আমাকেও প্রচুর সাহায্য করেছিল। তবে যেহেতু পরীক্ষা হবে এমসিকিউ পদ্ধতির সেহেতু আমাদের প্রস্তুতির রকমও ছিল ভিন্ন। বিশেষ করে আমার পড়ার বইয়ের বাইরে প্রচুর পড়া থাকায় আমি এ নিয়ে মোটেও সিরিয়াস ছিলাম না। পরীক্ষা হলো, আমরা দু’জনেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। মহিলা ও মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা আগে শুরু হলো এবং আমাদের মৌখিক পরীক্ষা শেষ হবার আগেই ৩ এপ্রিল ১৯৮৩ তাঁরা কোটা’তে সংক্ষিপ্ত আইন প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগদান করেন।