জালাল আহমেদ
আমাদের সময়ে সরকারই ছিল সবচেয়ে বড় এমপ্লয়ার, এখন কর্মক্ষেত্রের পরিধি ব্যাপক ॥ আর্থিক ও রপ্তানীমুখী খাত অনেক বিকশিত

প্রথম বিসিএস পরীক্ষা ১৯৮২ এর নম্বর বিতরণ ছিল এরকম: বাধ্যতামূলক ৭ পেপারে ৭০০ (বাংলা-১০০, বাংলা রচনা-১০০, ইংরেজী-১০০, ইংরেজী রচনা-১০০, সাধারণ জ্ঞান-১০০, বাংলাদেশ বিষয়াবলী-১০০, গণিত-১০০), ইচ্ছাধীন ৬ পেপারে ৬০০, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিমত্তা ১০০ এবং মৌখিক ২০০, মোট ১৬০০ নম্বর। ফলে আমার সুযোগ এসে যায় স্বপ্ন পূরণের, বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করার। আমি অনার্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ এই সনদসহ আবেদনপত্র জমা দেই। বিসিএস পরীক্ষায় বিষয় নির্বাচন ও ক্যাডার নির্বাচন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দুটি বিষয়ের বিবেচনা আমার কাছে দুই রকম। ক্যাডার নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই প্রাধান্য দিয়েছি আমার জীবনের লক্ষ্যকে, এতে এমন কি আমি ক্যাডার তালিকাই করতে পারছিলাম না কারণ অন্য কোন ক্যাডারে চাকুরী করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। ফলে তালিকার প্রথমে প্রশাসন লিখে বাকি কয়েকটি ক্যাডারের নাম লেখা আমার জন্য কঠিন ছিল। আর আমি আত্মবিশ্বাসীও ছিলাম যে আমার পছন্দের ক্যাডার আমি পাব। কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে যদি এমন কোন দৃঢ় পছন্দ না থাকে তাহলে ক্যাডার পছন্দে অনেক যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করে দেখতে হয়। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কারো পরামর্শ গ্রহন বাঞ্ছনীয়। আর বিষয় নির্বাচনে পরিচিত বিষয় এবং কম পরিশ্রমে নাম্বার পাওয়া সম্ভব এমন বিষয় বেছে নেওয়া ভালো। যদিও আমি নিজে তা করি নাই। আমি বিষয় নির্বাচন করেছিলাম সাধারণ ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং লোক প্রশাসন। তিনটি বিষয়েই লিখতে হবে বেশী আর নাম্বার উঠবে কম। তাই এক্ষেত্রে আমাকে অনুসরণের কোন উপায় নেই। তবে আমাকে যদি আবারো বিষয় নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হয় তবে অনেক চিন্তা ভাবনা করে আবারো আমি এই বিষয়গুলোই নিবো হয়তো। নাম্বার বেশী উঠবে এই বিবেচনায় ইসলামের ইতিহাস বা মনোবিজ্ঞান নিয়ে পরীক্ষা দিতে যাবো না, আর লোক প্রশাসন তো আমার নিজের বিষয়।
আমাদের সময়ে বিসিএস কোচিং বলে কোন কিছু ছিল না। তবে আমাদের আগের ব্যাচ, ১৯৮১ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে কোচিং ধরণের কিছু একটার আয়োজন করেন। তাদের সঙ্গে সিভিল সার্ভিসের বাহিরেরও কয়েকজন প্রশিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেক্স ভবনে আমাদের ক্লাশ হতো যেখানে আমরা সম্ভবতঃ ২০/২৫ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেই, এদের মধ্যে অনেকেই আমরা সফল হই। প্রশিক্ষকদের মধ্যে বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসের যারা প্রশিক্ষক ছিলেন, রাষ্টদূত হুমায়ুন কবির, প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন এবং প্রাক্তন সচিব ড. মাহফুজুল হক, তাঁদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখনো আছে। ১৯৮২ সালের ৪ অক্টোবর আমাদের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষায় আমার সিট পড়ে জগন্নাথ কলেজে। আমি আগে উল্লেখ করেছিলাম যে আমি অংকে দুর্বল। আর ইচ্ছাধীন বিষয়গুলোও ভালো নাম্বার পাবার উপযোগী নয়। পরীক্ষা যখন শুরু হয়, বিশেষ করে বাধ্যতামূলক বিষয়গুলোর পরীক্ষা ভালোই হয় বিশেষ করে অঙ্ক খুব খারাপ হয় নাই। সাধারণ জ্ঞানের একটি প্রশ্নে ৮টি বইয়ের নাম দিয়ে বইয়ের ধরন ও লেখকের নাম চাওয়া হয় নইলে বিকল্প ছিল একটি রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর। আমি পাচটি বইয়ের নাম জানতাম, তাই দিলাম সময় বাঁচাতে কিন্তু আমার চেনা একজন, যে পরে বিসিএস পরীক্ষায় পাস করেনি, সে আলোচনা করে আটটাই পেরেছিল, এতে আমার মন খারাপ হল। কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে ওই তিনটা বইই খুঁজে বের করলাম যার একটার উপর টিকা এসেছিল ইতিহাস পরীক্ষায়। আমাদের রচনা ছিল বাংলা ও ইংরেজী ১০০ নম্বর করে। বিশেষ করে ইংরেজী রচনা পরীক্ষার আগের দিন ইংরেজী দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে প্রায় পুরো পাতা জুড়ে একটি উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়। পত্রিকা পড়ার সব সময়ের অভ্যাস তো আছেই বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষার সময়তো এটা আবশ্যকীয়। আমি লেখাটি ভালোভাবে পড়লাম এবং পরদিন ইংরেজী রচনা হিসেবে অন্য কয়েকটির মাঝে পেয়ে গেলাম এর সংগে সম্পর্কিত ঝড়পরড়-বপড়হড়সরপ বভভবপঃং ড়ভ ভধসরষু ঢ়ষধহহরহম। আমি রেফেরেন্স উল্লেখ করে করে রচনাটা লিখতে পারছিলাম এবং নিশ্চিত যে এটি যথেষ্ট ভালো নাম্বার পেয়েছিল। ইচ্ছাধীন বিষয়ের পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভাগ্য এত অনুকূল ছিল না এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার সময় আমি অসুস্থ হয়ে যাই ফলে আমাকে সিক বেডে পরীক্ষা দিতে হয়। আমার ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমি খুব ভালো নাম্বার পাইনি।
ইতোমধ্যে আমার লোক প্রশাসন অনার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। যেমন বীজ বপন করেছিলাম তেমন ফল! আমি প্রথম শ্রেণী প্রত্যাশাও করি নাই, তেরো নাম্বার কম থাকায় দ্বিতীয় শ্রেণীই পেয়েছি, ক্রমানুসারে এগারোতম। পাঁচজন পেয়েছিল প্রথম শ্রেণী, আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ষষ্ঠ। পরে মনে হয়েছে কতইনা সহজ ছিল তিন বছরে এই ১৩ নাম্বার যোগ করা। তবে অভ্যাসবশতঃ নির্দিষ্ট কিছু অর্জনের পেছনে আমি ধাওয়া করি নাই, তবে নিজের সততা, দক্ষতা, সক্ষমতা দিয়ে টিকে থাকতে পেরেছি। একে আমি বলি “কিলার ইন্সটিঙ্কট” যার ঘাটতি আছে আমার। তবে সাফল্যের ক্ষুধা আর “কিলার ইন্সটিঙ্কট” এক নয়, সাফল্যের ক্ষুধাটুকু থাকতে হয়। আর একটি বিষয় যে, আমাদের সময়ে সরকারই ছিল সবচেয়ে বড় এমপ্লয়ার, গত ৩৮ বছরে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। আর্থিক খাত অনেক বিকশিত, বিকশিত রপ্তানীমুখী খাত। আগের তুলনায় কর্মক্ষেত্রের পরিধি এখন অনেক ব্যাপক, পছন্দের সুযোগও অনেক বেশি। ফলে ছাত্ররা বিসিএস কেন্দ্রিক চিন্তা না করে নিজের প্যাশনকে লালন করার বা উদ্যোক্তা হবার সুযোগ নিতে পারছে।