স্মরণ
আব্দুল আউয়াল তালুকদার

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশের) জনসাধারণকে পশ্চিম পাকিস্তানে নানান অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করতে হয়। শুরু হয় সর্বত্র বৈষম্য, অর্থনীতিতে, উন্নয়ন কাজে, সামারিক বাহিনীতে, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কারখানায়, চাকরিতে অনুপাতিক হারে আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” পরবর্তীতে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামে মাধ্যমে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। বাঙালি অধিকার, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, স্বাধীনতা এবং আলাদা মানচিত্র জন্যই বাঙালিকে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য এই বাংলায় অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত গণমানুষের হৃদয়ে স্থান দখল করতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা ভূখন্ড, আলাদা মানচিত্র ও স্বাধীনতা তথা গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে বাঙালি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করা হয়। তিনি আওয়ামী লীগকে গণমানুষের আস্থার দল গঠন করতে নানান পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব গ্রহণ করে সারা বাংলা সাংগঠনিক সফরে বেরিয়ে যান। পাড়া থেকে মহল্লা, ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন, থানা জেলায় প্রতিটি অঞ্চলে নেতা কর্মীদের নিয়ে গণমানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। মানুষকে সংগঠিত করতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আহবান মনোযোগ সহকারে বুঝেছেন সমর্থন জানিয়েছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের প্রিয় নেতা হতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন “আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালবাসি।”
গণমানুষের রাজনীতির প্রতিদান হিসাবে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে এক ভিক্ষুক মহিলা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন আমি দেশের জন্য তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনে খরচের জন্য তোমাকে ১০ পয়সা দিলাম। বঙ্গবন্ধু উক্ত ভিক্ষুকের অনুদান সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি স্বাধীকার আন্দোলন তথা গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছিলেন। বিশেষ করে পুরান ঢাকাবাসীর অবদান অতুলনীয়। পুরান ঢাকাবাসীর মুরুব্বীরা তাদের অর্থবিত্ত আওয়ামী লীগের ফান্ডে দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা পুরান ঢাকাইয়ারা করতেন। বঙ্গবন্ধু জীবিতকালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা করতে ঢাকাবাসীর অবদানের কথা স্বীকার করতেন। বঙ্গবন্ধু সারা বাংলায় সাংগঠনিক সফরে এসে আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল যে আলাদা ভূখন্ড আলাদা পতাকা দিতে পারব। সেই লক্ষে আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করেন। আন্দোলন, অসহযোগ গণআন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সব কিছু পরিকল্পনা সঠিক তৈরি করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রবল ইচ্ছা শক্তি প্রচন্ড স্বদেশ প্রেম এবং আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ফসল বাংলাদেশ নামক আলাদা রাষ্ট্র পতাকা ও মানচিত্র। গণমানুষকে বঙ্গবন্ধু ভালবাসতেন বলেই ড. ফরাস উদ্দিন যখন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসাবে যোগদান করেন তখন তিনি তাঁকে সতর্ক করে বলে দিলেন আমার কাছে বড় লোক বা ধনী মানুষ যারা আসবে তাদেরকে বুঝে শুনে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিবে। কিন্তু আমার কৃষক, শ্রমিক, জেলে, কামার, কুমার মেহনতী মানুষ আসলে তাদেরকে ফিরিয়ে দিবে না। আমি তো সারা জীবন তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। তারাই আমার মূল প্রেরণা শক্তি। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল বাংলার গণমানুষকে ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর মত এমন গণমানুষের কাছাকাছি কোন নেতা আর আসবে না।
বঙ্গবন্ধুকে গণমানুষেরাই স্মরণ করে বেশী। তাদের এই স্মরণ কোন লোক দোখানোর প্রতিযোগিতা নয়। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন গণমানুষেরাই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে।

লেখক: আব্দুল আউয়াল তালুকদার
লেখক, প্রাবন্ধিক
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক