বনরুই সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়ে মাটি শুঁকতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উঁইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলে শক্তিশালী নখের থাবা দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলে। এরা মাটির নিচে প্রায় ছয় মিটার গর্ত করে বাসা বাঁধে

আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্তঘেষা নালুয়া চা বাগানের একটি কুয়া থেকে মহাবিপন্ন বনরুই উদ্ধার করা হয়েছে। বণ্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ হবিগঞ্জের সাতছড়ি বন বিভাগ এটি উদ্ধারের পর জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবু। এসময় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শামছুন্নাহার চৌধুরী, সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সাতছড়ি রঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মোতালেব, হবিগঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা রেহান মাহমুদ, বিট কর্মকর্তা শামছুদ্দিন রুমি, চিত্ত দেববর্মাসহ বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
বুধবার সকাল ৮টায় নালুয়া চা বাগানের গোলটিলা এলাকার রিক্সাচালক উসমান আলী ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে হাত মুখ ধোয়ার জন্য বাবুল মিয়ার নলকূপে যান। তখন পাশেই থাকা কুয়ার মাঝে নড়াচড়ার শব্দ শোনে কিছুটা ভয় আর কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যান কুয়ার কাছে। গিয়ে দেখেন একটি অপরিচিত প্রাণী কুয়ার ভেতর নড়াচড়া করছে। এরপর সবাইকে নিয়ে খুন্তি দিয়ে মাটি খুড়ে কুয়ার ভেতর থেকে উপরে নিয়ে আসেন প্রাণীটি। প্রানিটি উদ্ধারের পর বাগানে খবর ছড়িয়ে পড়লে এটি দেখতে তার বাড়িতে শত শত মানুষ ভিড় করে। স্থানীয় ইউপি সদস্য নটবর রুদ্রপাল বিষয়টি জানান হবিগঞ্জের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা রেহান মাহমুদকে। সাথে সাথে রেঞ্জ কর্মকর্তা বিষয়টি জানান সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মোতালেব ও সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে। পরে দুপুর ২টায় রেঞ্জ কর্মকর্তা রেহান মাহমুদ, আব্দুল মোতালেব ও সিএমসির সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ নালুয়া চা বাগানের ইউপি সদস্য নটবল রুদ্রপালের সহযোগিতায় বনরুইটি উদ্ধার করে সাতছড়ি নিয়ে যান। সেখানে বিকাল ৪টায় মহাবিপন্ন বনরুইটি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়।
উসমান আলী জানান- বনরুইটি আটকের খবরটি মুহূর্তেই রটে গেলে তার বাড়িতে শত শত লোক এসে ভিড় জমায় প্রাণীটিকে একনজর দেখার জন্য। শিশুদের মাঝে ছিল ব্যাপক উৎসাহ।
রিক্সাচালক উসমান আলী বলেন ‘আমি কুয়ার মাঝে শব্দ ও নড়াচড়া দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখি এটি আক্রমণ না করে মাথা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। সবাইকে নিয়ে মাটি খুঁড়ে এটিকে ওপরে নিয়ে আসি। এটি দেখতে খুবই সুন্দর। লোকজন দেখে অনেক আনন্দ পেয়েছে। এর ওজন ৫ কেজি এবং ৪ ফুট লম্বা হবে।’
নালুয়া চা বাগানের শ্রমিক নেতা ও আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের মেম্বার নটবর রুদ্র পাল বলেন ‘এই প্রাণী আমার জীবনেও দেখিনি। আমি জানার পর সবাইকে বলেছি যাতে কেউ এটিকে আঘাত না করে। এটিকে সুস্থ অবস্থায় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
হবিগঞ্জ বন বিভাগের ডেপুটি ফরেস্টার রেহান মাহমুদ জানান, সুস্থ অবস্থায় বনরুইটিকে উদ্ধার করে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের গভীর জঙ্গলে অবমুক্ত করা হয়েছে। মুহূর্তের মাঝেই এটি গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যায়। প্রাণীটি বিপন্ন। এক সময় চুনারুঘাট উপজেলার পাহাড় ও বনাঞ্চলে এটি প্রচুর পরিমাণ দেখা যেত।
হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, হবিগঞ্জের বনাঞ্চলে এই প্রাণিটির আবাস ছিল। বিশেষ করে ছন ও ঝোপ-জঙ্গলে এগুলো দেখা যেত। এটি প্রাণিকূলে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণি। সারা শরীরে মাছের মতো আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। স্বভাবেও অতি অদ্ভুত। কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, লম্বা লেজ গাছের ডালে জড়িয়ে ঝুলেও থাকতে পারে। বিপদ বুঝলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে বলের মতো করে নেয়। একবার সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণিও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এ নিরীহ প্রাণিটি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে। সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়ে মাটি শুঁকতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উঁইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলে শক্তিশালী নখের থাবা দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলে। এরা মাটির নিচে প্রায় ছয় মিটার গর্ত করে বাসা বাঁধে। শীতকাল প্রজনন মৌসুম। সাধারণত একটি বা দুইটি বাচ্চা দেয়।
বিশ্বে ৮ প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে। তারমধ্যে বাংলাদেশে মালয়, ভারতীয় ও চায়না বনরুই ছিল। বর্তমানে চায়না বনরুই ছাড়া অন্য প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মিলছে না। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে বনরুই।
তিনি আরও বলেন, বনরুইয়ের ইংরেজি নাম ‘Pangolin’ চায়না বনরুইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম ‘Manis pentadactyla’। দাঁত নেই বলে আগে দন্তহীন স্থ্যন্যপায়ী প্রাণির দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডাটার (Pholidata) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার সদস্য একমাত্র বনরুই। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও চট্টগ্রামে এক সময় প্রচুর পরিমাণ বনরুই থাকলেও এখন তেমন একটা দেখা মিলে না। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ পরিষদ (আইইউসিএন) এই প্রাণীকে মহাবিপন্ন প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও বাপার আজীবন সদস্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, হবিগঞ্জের বনাঞ্চল হরেক রকম পাখি এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত। তবে নির্বিবাদে বন উজাড় করার কারণে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও খাদ্যের সংকটের জন্য অনেক সময় বণ্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসে। তবে বনরুইটিকে আটক করার পর কেউ এটিকে আঘাত না করার জন্য তাদেরকে তিনি ধন্যবাদ জানান। কারণ বিভিন্ন সময়ে লোকালয়ে আসা প্রাণীকে মেরে ফেলার ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। তিনি আরও জানান, বনরুই মাংস ও আঁশের জন্য শিকার করা হয়ে থাকে। কিছু ভন্ড কবিরাজ বনরুই মেরে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে তথাকথিত ওষুধ তৈরির নাম করে ব্যবসা ফাঁদছে। বাংলাদেশের মতো চীন এবং ভিয়েতনামেও লোকজ ওষুধ তৈরির জন্য বনরুই ব্যবহার করা হয়। কিডনির রোগ, অ্যাজমা বা রক্ত সঞ্চালন বাড়ানোর জন্য বনরুইয়ের আঁশ দিয়ে কবিরাজি ওষুধ তৈরি করা হয়। যদিও এসব ওষুধের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। হবিগঞ্জের আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন সময় বনরুইয়ের তৈল বিক্রি করতে দেখা গেছে। এই প্রাণীটিকে রক্ষা এবং এর ওপর গবেষণার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।