নির্লোভী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না পেলে ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠনের অস্থিত্ব হুমকির মুখে পড়বে

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ বাংলাদেশে যেমন বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাদের আলাদা আলাদা সংগঠন। তা স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা তাদের সংগঠনের অধীনস্থ লোকজনের উপর বেশ প্রভাব খাটিয়ে থাকে। দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলোর বেশ কয়েকটি জাতীয় পর্যায়েও নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তবে দায়িত্বের ক্ষেত্রে তারা অনেকটা উদাসীন। তাদের বড় নেতারা সরকারের সুবিধাভোগী হয়ে অনেক ক্ষেত্রে নিরব ভূমিকা পালন করেন। ফলে তাদের অধীনস্থরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই অবস্থায় দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন এক ছাতার নিচে না আসলে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে নির্লোভী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না পেলে ভবিষ্যতে এসব সংগঠনের অস্থিত্বই হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সহ-সভাপতি ও জাতীয় হিন্দু মহাজোট হবিগঞ্জ জেলা শাখার আহবায়ক অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বলেন, দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলোর বেশ কয়েকটির জাতীয় পর্যায়ে অস্থিত্ব থাকলেও তারা কঠিন অবস্থানে নেই। তাদের বড় নেতারা সরকারের সুবিধাভোগী হয়ে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে অনেকটা নিরব ভূমিকা পালন করে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ সরস্বতী পূজার জন্য নির্বাচনের দিন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মাঠে নামার পর তারা সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে। যে সংগঠন তার দায়িত্বের ক্ষেত্রে এতটা উদাসীন তাদের দ্বারা ভাল কিছু আশা করা যায় না। তবে এর মধ্যেও এক দুইটি সংগঠন রয়েছে যারা হয়তো সারা বাংলাদেশে তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি, তারপরও তাদের বক্তব্য বা কথা বলার ধরণ প্রতিবাদের ভাষা আশাব্যঞ্জক। মূলত আঞ্চলিক কিছু সংগঠন কাজ করে যেমন- খাসিয়াদের নিজস্ব সংগঠন, গারোদের নিজস্ব সংগঠন, চাকমা-মারমা এদের নিজস্ব সংগঠন। এদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে তারা যতেষ্ট প্রতিবাদী। সংখ্যায় কম হওয়ার ফলে সারা দেশে তারা প্রভাব বিস্তার না করতে পারলেও তাদের ঐক্য যথেষ্ট ভাল।
তাছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠনের নিজেদের মধ্যে বিভেদ বিদ্যমান। সবাই নেতা হওয়ার আশায় সংগঠন ভেঙ্গে বা নিজেদের স্বার্থে আভ্যন্তরীন কোন্দল সৃষ্টি করে নিজেদেরকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন ছোট ছোট এলাকাতেও জাত, বর্ণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে রেশারেশিতে লিপ্ত। এর ফলে সংগঠনগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। সম্প্রতি লক্ষণীয় বিষয় ব্রাহ্মণ, নমঃশুদ্র, শীল সম্প্রদায়, কায়স্থ সম্প্রদায় তারা আলাদা আলাদা সংগঠন তৈরী করেছে। এতে তাদের মূল জায়গাটি অর্থাৎ একই ধর্মের অনুসারী এই বিষয়টি থেকে ঐক্যের সুর না তুলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বায় পরিণত হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে বৃহৎ দলগুলো এই সংগঠনগুলোকে নিজেদের মতো করে তৈরী করার চেষ্টা করে। ঢাকাতে অবস্থানগত নেতারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাঁধে ভর করে নিজেরা নেতা হয়ে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন নিজেদের ছোট ছোট স্বার্থ থেকে বের হয়ে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিবেদিত প্রাণ নেতৃত্ব না আসলে তাদের বহিঃশত্রুর প্রয়োজন নেই। নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করার জন্য যতেষ্ট হয়ে উঠবে। এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ইদানিংকালে দেখা যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে দু’একটি প্রেস কনফারেন্স এবং একটি দুটি মানববন্ধন করেই কেন্দ্রীয় নেতারা দায় সারছেন। এই অবস্থায় দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন এক ছাতার নিচে না আসলে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে নির্লোভী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না পেলে ভবিষ্যতে এসব সংগঠনের অস্থিত্বই হুমকির মুখে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের আইনী সহায়তা দেয়ার জন্য তিনি হবিগঞ্জ জেলা থেকে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা দেয়ার জন্য আমাদের মধ্য থেকে একটি আইনজীবী প্যানেল তৈরি করা হোক। এই প্যানেল বিনা ফিতে এবং দায়িত্ব সহকারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্প্রদায়গত কারণে নির্যাতিত হলে এবং জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ থেকে নির্দেশিত হলে তারা আইনগত সহায়তা প্রদান করবেন। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শঙ্খ শুভ্র রায় আন্তরিকভাবে কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু দিনের মধ্যেই ওই প্যানেল তৈরি করে পত্রিকার মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা তাদের আর্থিক অনটনের কারণে বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারছেন না। অপরদিকে অনেক সময় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের ভয়ে আদালত চত্ত্বরে আসতেও ভয় পান। সেই ক্ষেত্রে একজন নির্যাতিত সংখ্যালঘুর মনের অবস্থা বা পারিপার্শ্বিকতা একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইনজীবী যেভাবে গুরুত্ব সহকারে দেখবেন তা অন্যের দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া অনেক সময় সিনিয়র আইনজীবীদের সাহায্য পাওয়াও তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠে বিধায় এইসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আইনজীবী প্যানেল তৈরির প্রস্তাবটি তোলা হয়।
দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠন ও তার প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নবীগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার পাল হিমেল বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি সংগঠন থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে তারা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংগঠন বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দেখা যায় স্থানীয় সৃষ্ট কোন সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় পর্যায়ে যোগাযোগ করে সমন্বয় করতে করতেই ওই সমস্যার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। বরং স্থানীয় সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উদ্যোগ নিলে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়। সমস্যার সমাধানে যাওয়াও অনেক সহজ হয়। আর বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এখন অনেক সচেতন। যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে তারা দ্রুত স্থানীয় সংগঠন সমূহের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে বিচারপ্রাপ্তি অনেক সহজ হয়। যদিও স্থানীয় পর্যায়েও অনেক বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। এই বিভেদ নিজেদের ক্ষতি করে থাকে। দলিত সংখ্যালঘুদের বৃহৎ স্বার্থে নিজেদের মধ্যে থাকা বিভেদ দূর করে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে।
মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠন বিষয়ে অবস্থার পার্থক্য সম্পর্কে তিনি বলেন, সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলোর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। নিজেদের মধ্যে ঐক্য থাকলে যত বাধাই আসুক সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে ঐক্য থাকার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্ট অনেক সমস্যার সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। ফলে একজন অন্যায়কারী পরবর্তীতে কোন অন্যায় করতে ভয় পায়। তাই তিনি স্থানীয় সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে নিজেদের বৃহৎ স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান।