॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
দুই সপ্তাহ পূর্বে একটি বাস্তব ঘটনা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার দুটি লেখা দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকায় প্রকাশ হয়। ফেসবুকেও লেখা দুটি শেয়ার করি। এর প্রথমটির শিরোনাম ছিল ‘অজ্ঞাত রোগীর চিকিৎসা বিভ্রাট।’ আর দ্বিতীয়টির শিরোনাম ছিল ‘ওসমানীতে দেখতে গেলাম সেই অজ্ঞাত রোগীকে।’ লেখাগুলো অনেককেই আকৃষ্ট করে। কারণ আমার কাছে তাদের অনুভূতি শেয়ার থেকেই বুঝতে পেরেছি। লেখাদু’টি সিকোয়েল সিনেমার মত একটির পর আরেকটিতে ধারাবাহিকতা ছিল। ট্রিলজি সিনেমার মত তৃতীয় পর্ব নিয়েও হয়ত অনেকের আগ্রহ আছে। আমার নিজেরও আগ্রহ ছিল। কারণ প্রথম লেখায় একজন অজ্ঞাত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির নিশ্চয়তার তথ্য ছিল। দ্বিতীয়টিতে ওসমানী মেডিকেল কলেজের মত বড় প্রতিষ্ঠানেও অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। শেষ পর্যন্ত রোগী ভাল হয়েছিল কিনা কিংবা কি তার পরিচয় তাও জানার আগ্রহ ছিল অনেকের। আমার নিজেরও ছিল অনেক আগ্রহ। আমি প্রতিদিন সিলেটে থাকা বন্ধু বান্ধবকে ওই রোগীর খোঁজ নিতে বলতাম। আর ওসমানীতে কর্মরত হবিগঞ্জের যারা ছিলেন তাদের সাথেও যোগাযোগ করতাম। বিশেষ করে বন্ধু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিলকে বেশী তাগিদ দিতাম। তবে শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার আমার আবারও সিলেটে একটি জানাজায় যেতে হওয়ায় সুযোগ হয় ওসমানীতে যাওয়ার। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর জহিরুল হক শাকিল এবং আরও দুইজনকে সাথে নিয়ে ছুটে যাই ওসমানীতে। তৃতীয় তলায় উঠে যখন সার্জারী ও নিউরো সার্জারী ওয়ার্ডে প্রবেশ করি তখন যেখানে আমার সেই অজ্ঞাত রোগী ছিল সেখানে গিয়ে দেখি তাকে নেই। সেখানে আরেকজন নতুন রোগী। আমার মনে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হল। চিন্তায় পড়ে গেলাম সেই মুমূর্ষ রোগী তো এত অল্প সময়ে ভাল হয়ে যাওয়ার কথা নয়। মারা গেল কিনা? সেখানে আসা রোগীর সাথের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কবে এসেছেন? তারা জানায় ওই দিনই তারা সেখানে এসেছেন। চলে গেলাম নার্স কাউন্টারে। সেখানে বসা নার্স শাহনাজ পারভীনকে নিজের পরিচয় দিয়ে রোগীর বিছানা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি সেখানে একজন অজ্ঞাত রোগী ছিল। তার কি অবস্থা। তিনি বলেন, সেখানে অনেক অজ্ঞাত রোগী আসে এমনি বলা যাবে না। আমি তখন আমার মোবাইলে থাকা রোগীর ছবি দেখাই। তিনি তখন ছিনতে পারেন। বলেন ওই রোগী যখন হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারে তখন সে রিলিজ নিয়েছে। বেঁচে আছে শুনে স্বস্থির নিঃশ^াস ফেলি। তখন জিজ্ঞেস করি সুস্থ হওয়ার পর তার পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কিনা। তিনি বলেন না। আমি তখন তার রিলিজ এর কাগজ দেখাতে বলি। তিনি তা দেখাতে পারেননি। তখন চিন্তা করি সেখানকার আরও কোন রোগী আছে কিনা যারা অনেকদিন সেখানে ছিল। সেখানে গিয়ে পাই শওকত আলী নামে এক ব্যক্তিকে। তিনি সুনামগঞ্জের চাতকের একটি মসজিদের মোয়াজ্জিন। তিনি তার অসুস্থ পিতাকে নিয়ে সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করছেন।
শওকত আলীকে অজ্ঞাত রোগীর ছবি দেখাতেই তিনি চিনে ফেলেন। তিনি বলেন, ওই রোগীর নাম জানা যায়নি। জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে তার বাড়ী শরীয়তপুরে। সে বোতল কুড়াত। সম্ভবত সে ঢাকায় থাকত। কিভাবে সে হাসপাতালে এসেছে এবং কিভাবে আঘাত পেয়েছে তা বলতে পারেনি। আমরা তাকে কাপড় দিয়েছি। ফল এবং খাবার দিয়েছি। সে এগুলো পেয়ে আনন্দিত হত এবং আমাদেরকে পায়ে ধরে সালাম করত। সে কাউকে না বলেই হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরেও আসে। কিন্তু কয়েকদিন পূর্বে সে কাউকে না বলেই চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। তার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। তার প্রতি আলাদা একটা মায়া সৃষ্টি হয়েছিল সবার। ডাক্তাররাও বিশেষভাবে নজর দিতেন। সে প্রায় সময়ই ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঔষধ দিতে বলত। আমরা তাকে ১০/২০ টাকাও দিতাম।
যে লোকটি ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় সে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করে। যত আরাম আর সুযোগ সুবিধাই দেয়া হোক না কেন সে হাসপাতালে বসে থাকার নয়। যে লোকটিকে দেখে মনে হয়েছিল তার সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই সে ঠিকই সুস্থতার পথে চলে এসে বেড়িয়ে যায় প্রকৃতিতে। তারা অসুস্থতাকে জয় করে প্রকৃতিতেই টিকে থাকে। আর নার্স কেন রিলিজ এর কাগজ দেখাতে পারেনি তারও বুঝে গেলাম। কারণ না বলে যদি কোন অজ্ঞাত রোগী চলে যায় তাকে নার্স কেন পুলিশেরও খুঁজে পাওয়া কষ্ঠকর। আর পরিচয় জানতে আমাদের যে কৌতুহল ছিল তাও আর পূরণ হবে না। কারণ সেই অজ্ঞাত রোগী হারিয়ে গেছে দেশের ১৮ কোটি মানুষের মাঝে। তবে যেখানেই সে থাকুক, সে যেন সুস্থ থাকে এই কামনা করি। আর হবিগঞ্জ থেকে সিলেটে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আমার যে রোটারীয়ান এবং সাংবাদিক বন্ধুরা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই চাতকের সেই মোয়াজ্জিন শওকত আলীকেও।