তাহমিনা বেগম গিনি
ভালবাসার আবার দিবস হয় নাকি? প্রতিদিনিই তো ভালবাসা যায়। মা, বাবা, সন্তান, পরিবার, আশেপাশের প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন সবার সাথে যেমন ভালবাসা থাকে, তেমন মনোমালিন্য ও যে হয় না তা বলা সঠিক হবে না। কিন্তু তারপরও ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে বিশেষ ভাবে ঠধষবহঃরহব ফধু অথবা ভালবাসা দিবস বলা হয়। এর পিছনে যে ইতিহাস তা প্রেমের ইতিহাস, প্রায় সবার জানা তাই আর উল্লেখ করলাম না। আমাদের দেশে বেশ ক’বছর আছে শফিক রেহমান যায়যায়দিন পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশে ভালবাসা দিবস প্রচলন করেন। প্রচুর সাড়া পড়ে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীর মাঝে। যেন প্রকাশ্যে ভালবাসা জানানোর লাইসেন্স প্রদান। সেদিন একটি লাল গোলাপ অনেক দাম, লাল শাড়ী, লাল পাঞ্জাবী অথবা বসন্তকাল থাকায় হলুদ রঙের ও বাণিজ্য চলে। ভালবাসা দিবসে অনেক বাণিজ্য থাকে ব্যবসায়ীদের খাতায়। বিশেষ করে ফুল, কাপড়, ছোট ছোট খাবার দোকানগুলোতে। তবে সুলক্ষণ বলবো এই দিনটি এখন দুজনের মধ্যে না থেকে পরিবারের মাঝেও ছড়িয়েছে। তারপর ও প্রেমিক, প্রেমিকা আশা করেন ফুলের সাথে কোনো উপহার পাবেন। স্ত্রী আশা করেন আর কিছু না হোক স্বামী তাকে আজ একটি গোলাপ অথবা বাইরে কোথাও খাওয়াতে নিয়ে যাবেন। যদিও ধর্মীয়নীতি নির্ধারকরা বলবেন- সব নাফরমানী। এবছর কি হবে জানিনা। চারিদিকে ভালবাসার বড্ড অভাব। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা, হিংসা, ভাঙ্গাচুড়া, দাবী পেশ, নির্বাচন, সংস্কার- এর মাঝে যদি বসন্তের বাতাসের সাথে ভালবাসা রঙময় হয় তবে কিছুটা হলেও ভাল লাগবে। অনেক ভালবাসার কথা লিখেছি বহুবার পত্রিকার পাতায়। এবার নিজের কথাই বলি- ৬০ বছর একজনকে ভালবেসে চলেছি। গোপালগঞ্জের গ্রামে আমার বাড়ী। পড়াশুনার ইতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। দাম্পত্য জীবনের পঞ্চাশ বছর চলছে। তার আগে দশবছর ভালবেসেছি না দেখে উভয়-উভয়কে। তখনতো মোবাইল ছিলনা। কোনো প্রযুক্তি ছিলনা। চিঠি ছিল একমাত্র মাধ্যম। বিয়ের আগে দুবার দেখেছি। জীবনে গ্রামে থাকিনি, বিয়ের পর ১ বছর বানিয়াচং এবং স্বামীর চাকুরীসূত্রে সুজাতপুর ৪ বছর থেকেছি। জন্মেছিলাম সরকারী কর্মকর্তা বাবার ঘরে। সকল রকম সুবিধা এবং আনন্দের মাঝে শৈশব, কৈশোর, যৌবন কাটিয়েছি। বিবাহের পর একেবারে বিরূপ এলাকায়, সমাজে এসে অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু ভালবাসার অনেক শক্তি- যা মনকে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। তারপর সৌদিতে ১৩ বছর বাকী জীবন ছেলেদের মানুষ করতে দুজনে যে যার মত পরিশ্রম করেছি সাধ্যমত। হবিগঞ্জে যখন আসি তখন হবিগঞ্জও ছিল গ্রামের মত। ডাক্তার সাহেব (আমার স্বামী) পরিবারের কাছে থাকবেন এবং এলাকার মানুষের সেবা করবেন এই ব্রত নিলেন। মেনে নিলাম বিধাতা বোধহয় আমার জন্য এ জায়গাই নির্ধারণ করেছেন। ছেলেরা ডাক্তার হলো, বিয়ে দিলাম, নাতি নাতনি হলো। একে একে সব দায়িত্ব শেষ করলাম। কিন্তু আমরা দুজন কখনোই কাউকে ছেড়ে কোথাও যাইনি একটি রাতের বা দিনের জন্য। বয়সও আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো।
উনি হবিগঞ্জে গরীবের ডাক্তার, মানবিক ডাক্তার এবং সামাজিক মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেলেন। তেমন আমিও হবিগঞ্জের মানুষকে ভালবেসে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবক নির্বাচিত হলাম। আমি জানি আমি যেমন হবিগঞ্জ এবং হবিগঞ্জের মানুষকে ভালবাসি তেমন ওরাও আমাকে ভালবাসে। সবাই বাসবে সেটা আশা করিনা তবে আমরা দুজনা কারো কোনো ক্ষতি করি নাই। ছেলেরা যার যার মতো জীবন গড়লো। দুজনের হাত আরো আকড়িয়ে ধরলাম। এখন দুজনার জীবন। ছেলেরা, বউয়েরা আসে, খবর নেয়। সেটাকেই মেনে নিয়েছি। আমরা এখন নিজেদের মনে করি ঝড় এসেছে, তুফান এসেছে তবু কেউ কারো হাত ছাড়িনি। যদিও জানি এ হাত একদিন কারো না কারো ছাড়তে হবে। সেদিনের কথা মনে হলেই চোখ ভিজে ওঠে। মাঝে মাঝে ভাবি তখনকার ভালবাসা আর এখনকার ভালবাসা প্রকাশের কত তফাৎ তাইতো সমাজে আজ ছেলে মেয়েদের কত রকম বিপদ, আপদ, ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে- সাথে পরিবারকেও। তারপরও যদি এ পৃথিবীতে ভালবাসা, প্রেম, ¯েœহ এসব না থাকে তবে পৃথিবীটা এক্কেবারে বসবাসহীন হয়ে পড়বে। ভালবাসা নিয়ে অনেক কবি, দার্শনিক অনেক কথা বলেছেন। আমি মাত্র দুজনের উদ্বিৃতি দিবো- ওমর খেয়াম বলেছেন-
অনিত্য এই ধারায় জেনো
কিছুই বড় টিকতে নারে,
ভালবাসাই হেথায় শুধু
অমর হয়ে থাকতে পারে।
ইংরেজ কবি ব্রাটনিং বলেছেন-
প্রেমিকের ভালবাসাও এক সময় শিথিল হয়ে আসে, মানুষ তার স্ত্রী এবং তার স্বামীকে ঘৃণা করতে শেখে কিন্তু মা-বাবার ভালবাসাই একমাত্র আমৃত্যু তার সন্তানের প্রতি এককভাবে অনুরাগিত হয়।
ভালবাসা দিবসে এই সুন্দর পৃথিবী, যুদ্ধ, হত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার সব বন্ধ করে ভালবাসাময় হয়ে উঠুক এটাই আমার কাম্য। আসুন শুধু দু’জন নয় পরিবারের সবাইকে ভালবাসি।