এডিসি জেনারেলকে দিয়ে নোটিশ জারি করিয়েছি- অফিসের সকল স্টাফ ৯টা-৫টা অফিসে থাকবেন

১৮ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ বৃন্দাবন কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্যও কম না। সিলেট বিভাগে দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পুরোনো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৩১ সালে ‘হবিগঞ্জ কলেজ’ নাম নিয়ে। কলকাতার রিপন কলেজের দর্শনের অধ্যাপক বিপিন বিহারী দে প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠার বছরখানেকের মধ্যেই আর্থিক সমস্যার কারণে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে, বানিয়াচং উপজেলার ঐতিহাসিক বিথঙ্গল গ্রামের অধিবাসী ব্যবসায়ী বৃন্দাবন চন্দ্র দাস এককালীন ১০ হাজার টাকা দান করেন। কলেজের পরিচালনা কমিটি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর নামানুসারে এটির নাম রাখে- বৃন্দাবন কলেজ

আতাউর রহমান কানন

২৫ জানুয়ারি ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় আমার অভ্যাসমতো আমি অফিসে যাই। জরুরি অবস্থার কারণে দেশে কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাচ্ছে। প্রকৃতিও উষ্ণ হয়ে উঠছে; কিন্তু দেশের রাজনীতি ক্রমান্বয়ে যেন সব শীতল হয়ে যাচ্ছে। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলার উন্নতির সাথে সাথে অনেক কিছুতেই শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে চোখকান খোলা রাখতে হচ্ছে। তবে সেনবাহিনী সক্রিয় থাকায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। আমি আমার অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাই।
সকাল ১১টায় বৃন্দাবন সরকারি কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। বেশ সুন্দর আয়োজন ছিল। ১৮ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এই কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্যও কম না।
সিলেট বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পুরোনো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৩১ সালে ‘হবিগঞ্জ কলেজ’ নাম নিয়ে। কলকাতার রিপন কলেজের দর্শনের অধ্যাপক বিপিন বিহারী দে প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠার বছরখানেকের মধ্যেই আর্থিক সমস্যার কারণে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে, বানিয়াচং উপজেলার ঐতিহাসিক বিথঙ্গল গ্রামের অধিবাসী ব্যবসায়ী বৃন্দাবন চন্দ্র দাস এককালীন ১০ হাজার টাকা দান করেন। কলেজের পরিচালনা কমিটি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর নামানুসারে এটির নাম রাখেÑ বৃন্দাবন কলেজ। ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হওয়া কলেজটি প্রথমে কেবলমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মানবিক বিভাগে পাঠদান করলেও ১৯৩৯-৪০ শিক্ষাবর্ষে বিএ (পাস) এবং ১৯৪০-৪১ শিক্ষাবর্ষে কয়েকটি বিষয়ে বিএ (অনার্স) কোর্স চালু করে। ১৯৭৯ সালের ৭ মে কলেজটি জাতীয়করণ হয়ে ‘বৃন্দাবন সরকারি কলেজ’ নাম ধারণ করে। বর্তমানে কলেজটিতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে মাস্টার শ্রেণি পর্যায়ের কোর্স রয়েছে।
গতানুগতিক কাজকর্মের বাইরে এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। দেড়টায় কলেজের অনুষ্ঠান থেকে নিজ অফিসে ফিরে আসি।
২৮ জানুয়ারি ২০০৭, রবিবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। সাড়ে ৯টায় এডিএম ও এডিসিদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক সভা করি। দেশের সর্বশেষ অবস্থাও আমাদের সভায় আলোচনা থেকে বাদ যায় না। দেশে এখন নানামুখী সংস্কার চলছে। ঋণখেলাপি-বিলখেলাপির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। সরকারি আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা আসছে।
আজ ১১টায় জেলার বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিস সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সভা করি। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোন বিভাগের অনাদায়ী বিলসমূহ দ্রুত আদায়ের জন্য সভায় সিদ্ধান্ত হয়। আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে যৌথবাহিনী প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে মর্মেও সিদ্ধান্ত হয়। তবে আশার বিষয় যে, এ সভায় উপস্থিত সংস্থা প্রধানদের অনেকেই জানান যে, বিল আদায়ের বিষয়ে সরকারি ঘোষণার পর অনেকেই তাদের বকেয়া বিল পরিশোধ করছেন। এ সভায় জেলায় কর্মরত সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির ও পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন।
২৯ জানুয়ারি ২০০৭, সোমবার। আজ সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে পূর্বনির্ধারিত মাসিক সভা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পরপর ৮টি মাসিক সভায় সভাপতিত্ব করি। সভার ধরন বুঝে সভার সদস্যরা যোগদান করেন। তবে অধিকাংশ সভাতেই ইউএনওরা সদস্য। সভা ও অফিস শেষে সন্ধে সাড়ে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি।
আজ সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের সভা ও প্রকাশনা অনুষ্ঠান ছিল। আমি টেনিস খেলা বাদ দিয়ে সে সভায় যোগদান করি। সভায় যোগদান না করলে বুঝতাম না যে, কত লোক হবিগঞ্জে সাহিত্যচর্চা করে। উপস্থিতি দেখে বলা যায়, আমি একরকম অভিভূত! সবার সাথে পরিচিত হলাম। আজ প্রধান অতিথি হিসেবে হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রত্যয়’ এর ৩য় বর্ষঃ ৩য় সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করি। সাহিত্য পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ সিরাজ হকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক তরফদার মোহাম্মদ ইসমাইলের সঞ্চালনে অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন হবিগঞ্জের বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ। এদের মধ্যে ছিলেন- কবি তাহমিনা বেগম গিনি, অ্যাডভোকেট শাহজাহান বিশ্বাস, অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান, অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, অ্যাডভোকেট সুব্রত চক্রবর্তী, এম এ রব, এস এম ইলিয়াছ, গৌতম সরকার প্রমুখ। বক্তব্য শেষে হবিগঞ্জের কবিদের কবিতা আবৃত্তি শুনলাম। আমার আবৃত্তি শোনার জন্যও অনুরোধ এলো। কী আর করা! এসেছি পাগলের মেলায়, পাগলামি না করলে কি শোভা পায়? আমিও আমার কবিতা আবৃত্তি করলাম। সাহিত্যসভায় কীভাবে যে দুঘণ্টা কেটে যায় টেরও পেলাম না।
৩১ জানুয়ারি ২০০৭, বুধবার। সকাল ৯টায় বানিয়াচং উপজেলার নাগুড়ায় অবস্থিত শচীন্দ্র কলেজে যাই। আমি কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। সেখানে এবারই আমার প্রথম যাওয়া। কলেজ ক্যাম্পাসটি ঘুরে দেখলাম। সাজানোগোছানো বাগান, পরিকল্পিত পুকুর ও মাঠ। এককথায় নয়নজুড়ানো মনোরম পরিবেশ! হবিগঞ্জ শহরের বিশিষ্ট বস্ত্র ব্যবসায়ী শচীন্দ্র লাল সরকার তাঁর জীবন সায়াহ্নে নিজের সঞ্চিত ধনসম্পদ দান করে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি হবিগঞ্জের দ্বিতীয় বৃহত্তম কলেজ এবং সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত। আমি কলেজের গভর্নিং বডির সভা শেষে কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে কলেজ প্রবর্তিত বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদান করি। বৃত্তি প্রদান শেষে নবীগঞ্জ উপজেলার উদ্দেশে রওনা হই। সেখানে ১১টায় পৌঁছে ইউএনও অফিস ও এসি(ল্যান্ড) অফিস পরিদর্শন করে বিকেল ৩টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।
পহেলা ফেব্রুয়ারি ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে বসার মিনিট দশেক পরে আমার চেম্বারে সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির ঢুকেন। তাঁর সাথে সৌজন্য আলাপ করি ও চা পান করি। তিনি একফাঁকে বলেন, হবিগঞ্জের বিভিন্ন অফিসসমূহে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যথারীতি অফিসে আসা-যাওয়া ও দুর্নীতির বিষয়টি লক্ষ্য করা হচ্ছে। আমি বললাম, খুবই ভালো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স আমারও পছন্দ। আমার পূর্ণসহযোগিতা থাকবে।
থ্যাঙ্কস দিয়ে কর্নেল সাহেব চলে যান। অতঃপর আমি ১১টায় শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে গিয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। এসব অনুষ্ঠানে এলে আমার ছাত্রজীবনের নবীনবরণে আমি ফিরে যাই এবং সেসবের স্মৃতিচারণ করি। এ সময়ের আর আগেকার দিনের অনুষ্ঠানের মধ্যে তেমন পার্থক্য খুঁজে পাই না। তবে আগের চেয়ে এখন কিছুটা জৌলুশ বেড়েছে।
কলেজের অনুষ্ঠান শেষে বেলা একটায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। বেশ ক’জন সাক্ষাৎপ্রার্থী অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ দিই। এরপর নামাজ ও লাঞ্চ সেরে অফিসের কাজকর্ম শেষে বিকেল সাড়ে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি। কদিন ধরেই আমার একটা অভ্যাস হয়েছে- আমি অফিস ত্যাগের আগে কালেক্টরেট ভবনের সবগুলো তলাতেই হেঁটে হেঁটে চেক করি ৫টার পরে কেউ অফিসে আছে কী-না। আমার একটা ধারণা, অফিস ছুটির পর অফিসে বেশি অনিয়মের কাজ হয় এবং কর্মচারীরা অবৈধ ফায়দা হাসিলের কাজকর্ম করে থাকেন। এজন্য কিছুদিন আগেই এডিসি জেনারেলকে দিয়ে নোটিশ জারি করিয়েছি- অফিসের সকল স্টাফ ৯টা-৫টা অফিসে থাকবেন। অফিস ছুটির পর কেউ অফিসে থাকতে পারবেন না।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, শনিবার। সাপ্তাহিক বন্ধেরদিন হওয়ায় পরিবারের সাথে আমি বাসাতেই সময় কাটাই। আজ সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ নজরুল একাডেমি এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পুলিশ সুপার, সেনা ইউনিটের সিও ও আমি সপরিবারে সেখানে আমন্ত্রিত। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ অনেকেই যোগদান করেন। দেশের জরুরি অবস্থার শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে এমন একটি অনুষ্ঠান আমাদের মনে বেশ প্রশান্তি এনে দেয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রণে আমার স্ত্রী-কন্যাও নজরুল সংগীত পরিবেশন করে। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়।
পরের দিন রবিবার সকাল থেকেই অফিসে অবস্থান করি। বেলা একটায় সার্কিট হাউজের সেনা ক্যাম্পে ৩ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভোজসভায় যোগদান করি।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, মঙ্গলবার। আজ সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে জেলা প্রশাসন ও ইউনিসেফ কর্তৃক আয়োজিত সার্বজনীন জন্মনিবন্ধন কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকি। এতে জেলা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা, সকল ইউএনও, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা, সুধীজন ও প্রেসক্লাবের সাংবাদিকগণ অংশগ্রহণ করেন। অজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশের নাগরিকগণের প্রায় সকলেরই দুটি জন্মদিন নিয়ে চলতে হচ্ছে। অথচ ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৩ সালে ভারতবর্ষে জন্ম নিবন্ধন আইন করা হয়েছিল। সে সময়ে সঠিক সময়ে জন্মনিবন্ধনে ব্যর্থ অভিভাবক ও দায়িত্বরতদের জরিমানা শাস্তির বিধান ছিল। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে নতুন করে ২০০৪ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়; কিন্তু জনগণের মধ্যে এখনও তেমন সারা জাগেনি। তাই সরকার ইউনিসেফের সহযোগিতায় জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তারই অংশ হিসেবে আজকের এই কর্মশালা। (চলবে…)