থমথমে নবীগঞ্জ শহর ॥ ১৪ জন গ্রেফতার
এম এ আহমদ আজাদ, নবীগঞ্জ থেকে ॥ নিহত কলেজ ছাত্র তাহসিনের লাশ শহরে রেখেই নবীগঞ্জে দুই গ্রুপের ৫ ঘন্টাব্যাপী ভয়াবহ সংঘর্ষে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শহরে কমেছে মানুষের চলাচল। সংঘর্ষের ঘটনায় সাংবাদিক-পুলিশের ওসিসহ উভয়পক্ষের শতাধিক লোকজন আহত হয়েছে। ভাংচুর করা হয় মার্কেটসহ বিভিন্ন দোকানপাঠ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ ঘটনায় মামলা দায়ের না হলেও ১৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এ ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে দোকান খুলছেন না ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার সারাদিন বন্ধ ছিল রাজা কমপ্লেক্স এর সকল দোকান ও মার্কেট এর উপর তলায় থাকা পূবালী ব্যাংক।
গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নবীগঞ্জ শহরের নতুন বাজার এলাকায় এক টানা সংঘর্ষ চলে। পরে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কঠোর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে আটক করা হয়।
এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলো ইনাতাবাদ গ্রামের মোঃ আশফাক আলীর পুত্র নাসির মিয়া (২৫), একই গ্রামের ছাদিক মিয়ার পুত্র আবু জাহেদ (৩৪), মৃত সমাই উল্লাহর পুত্র ফজল মিয়া (৩৮), মৃত খাফল উল্লার পুত্র ছুনু মিয়া (৩৪), সাজ্জাদ আলীর পুত্র জুবেদ মিয়া (২৪), মৃত ইস্কন্দর মিয়ার পুত্র বিল্লাল মিয়া (২৩), রুঘু মিয়ার পুত্র রাজু মিয়া (২৪), অনু মিয়ার পুত্র দিলদার (২৬), মালিক মিয়ার পুত্র খালেদ মিয়া (২৮), মৃত আব্দুল মন্নাফের পুত্র সোলেমান (৩৫), মৃত ফারাজ মিয়ার পুত্র মইন উদ্দিন (২১), মোঃ ফাহাদের পুত্র মোঃ মাফিন উদ্দিন (২০) ও আনমুনু গ্রামের হিযবু মিয়ার পুত্র তৌহিদ মিয়া (৩৫), মৃত এলাইছ মিয়ার পুত্র অন্তর মিয়া (২৬)।
নিহত রাইসুল হক তাহসিন (১৯) নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও বানিয়াচং উপজেলার কালাইনজুড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং নবীগঞ্জ শহরের শেরপুর রোডের রাজন ওয়ার্কশপের সত্ত্বাধিকারী রাজন মিয়ার ছেলে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়- ‘জানুয়ারী মাসে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নবীগঞ্জ শহরের যানজটের কারণ হিসেবে ফুটপাত ব্যবসা ও বাজারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে এবং ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তোলেন কুর্শি ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ খালেদুর রহমান খালেদ। বাজার পৌরসভার কাছ থেকে ইজারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত অর্থ আদায় করছে ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনমনু গ্রামের নানু মিয়ার স্বজন ও প্রতিবেশীরা। চেয়ারম্যান খালেদের বক্তব্যের পর নানু মিয়া ও তার স্বজন ইউপি চেয়ারম্যান খালেদের উপর ক্ষিপ্ত ছিল।’
স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর কুর্শি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খালেদুর রহমান খালেদের মালিকানাধীন রাজা কমপ্লেক্সের পিছনে পূর্ববিরোধের জের ধরে থু থু ফেলাকে কেন্দ্র করে রাইসুল হক তাহসিন (১৯) নামে এক কলেজ ছাত্রকে ১ম দফায় মারপিট করে আনমনু গ্রামের রিহাদ, অভয়নগর গ্রামের মান্না, রাতুল, জুয়েল, সাফি, রিমন। স্থানীয় লোকজন মারামারি থেকে তাদেরকে নিভৃত করে। পরে রাত ৯টার দিকে তাহসিনকে চৌদ্দহাজারি মার্কেটের সামনে পেয়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে করে মান্না-রিহাদসহ অন্যরা। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাহসিনকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথিমধ্যে তাহসিন মারা যায়। এ ঘটনায় শহরজুড়ে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। বুধবার বিকেলে কুর্শি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খালেদুর রহমান খালেদের মালিকানাধীন রাজা কমপ্লেক্সে তাহসিনের উপর হামলার সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করতে যায় পুলিশ। তবে তাহসিনের জানাজার নামাজের সময়ে হয়ে যাওয়ায় সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ ও ইউপি চেয়ারম্যান খালেদ জেকে উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজার নামাজে চলেন যান। এরপর আনমনু গ্রামের লোকজনের সঙ্গে ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে চেয়ারম্যান খালেদের লোকজনের বাকবিত-া হয়। এ ঘটনার জের ও পূর্বে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় চেয়ারম্যান খালেদের দেয়া বক্তব্যের ঘটনার সূত্র ধরে সন্ধ্যায় কাউন্সিলর নানু মিয়ার অনুসারী ও আনমনু গ্রামের লোকজন ইউপি চেয়ারম্যান খালেদুর রহমানের মালিকানাধীন মার্কেট রাজা কমপ্লেক্স ভাংচুর করে। খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান খালেদের অনুসারী ও এনাতাবাদ গ্রামের লোকজন রাজা কমপ্লেক্সে জড়ো হয়। পরে কুর্শি ইউনিয়নের এনাতাবাদ গ্রামের লোকজন ও আনমনু গ্রামের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে উভয় পক্ষ। ভাংচুর করা হয় রাজা কমপ্লেক্সসহ ২০টি দোকানপাঠ। অগ্নি সংযোগ করা হয় একটি মোটরসাইকেলে। শহর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দফায় দফায় টিয়ারশেল-রাবার বুলেট নিক্ষেপের পরও নবীগঞ্জ থানা পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় পরিস্থিতি। টানা ৩ ঘন্টা চলে সংঘর্ষ। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি তদন্ত গোলাম মুর্শিদ, এসআই পরিমল, আরও ৫ পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক লোকজন আহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় বশির মিয়া (৪৫), ফুলকাছ (৩৫), শেখ গাজী (২৫), তানভির (২২), গনি (৪৪), লোকমান (৩৮), খালেক (৪২) কে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছে উভয় পক্ষ, তবে পুলিশ বলছে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হয় সংঘর্ষ।
এ ব্যাপারে নিহত তাহসিনের পিতা বানিয়াচং উপজেলার কালাইনজুড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং নবীগঞ্জ শহরের রাজন ওয়ার্কশপের সত্ত্বাধিকারী রাজন মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে একটি সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ জনসম্মূখে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি এর সঠিক বিচার চাই। দাফন কাফন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এবং আমার ছেলের লাশ শহরে রেখেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষ। প্রায় ৫ ঘন্টা ব্যাপী সংঘর্ষ হয়। আমরা আতংকে শহরে যেতে পারিনি। এখন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এ ব্যাপারে রাজা কমপ্লেক্স এর সত্বাধিকারী কুর্শি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ খালেদুর রহমান খালেদ জানান, বন্ধুদের ছুরিকাঘাতে নিহত সৈয়দ রাইসুল হক তাহসিনকে প্রথমে রাজা কমপ্লেক্সে মারধর করা হয়। উক্ত ঘটনার সাথে কারা জড়িত ছিল তা চিহ্নিত করার জন্য মার্কেটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নেয়ার জন্য পুলিশ কর্মকর্তা মার্কেটে আসেন। এক পর্যায়ে তিনি পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত সৈয়দ রাইসুল হক তাহসিন এর জানাজার নামাজে চলে যান। জানাজা নামাজ শুরুর মুহূর্তে তিনি ফোনে খবর পান আনমনু গ্রামের লোকজন তার মালিকানাধিন রাজা কমপ্লেক্সে হামলা চালিয়েছে। তারা মার্কেটের সিসি ক্যামেরার ডিভাইসটি নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। বিষয়টি তিনি তাৎক্ষনিক জানাজা নামাজে উপস্থিত মুসল্লিদের অবহিত করেন। সৈয়দ খালেদের ধারণা মার্কেটে সৈয়দ রাইসুল হক তাহসিন আরে উপর যারা হামলা করেছিল তারাই হত্যাকান্ডের জড়িত। পুলিশকে সিসি ক্যামেরা দেখানোর কারণে সৈয়দ খালেদের উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে এবং সিসি ক্যামেরার ডিভাইসটি নিয়ে যেতেই মার্কেটে হামলা চালিয়েছে। এ সময় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিহত করে।’
অপরদিকে পৌর কাউন্সিলর আনমনু গ্রামের মোঃ নানু মিয়া জানান, রাস্তার পাশে ফুটপাতে লোকজন দোকানধারী করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ জন্য সৈয়দ খালেদ তার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে বলে বার বার অভিযোগ করেন। তাদের উচ্ছেদের দাবী জানান। অথচ তার মার্কেটের দোকানীদের ব্যবসার সাথে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কোন মিল নেই। অনেক দোকান তোলাও হয়েছে। ফুটপাতের দোকানীরা ফলমুল সব্জী ব্যবসা করে। সর্বশেষ গতকাল সৈয়দ খালেদ ওইসব দোকান থেকে আমি চাঁদাবাজি করি বলে বিভিন্ন ধরনের কথা বলাবলি করেন। আমি এ বিষয়টি জানতে পেরে জিজ্ঞেস করার জন্য রাজা কমপ্লেক্সে যাই। সেখানে গিয়ে অনেক লোকজন পাই। তাদের জানতে চাইলে তারা চেয়ারম্যান মার্কেটে নেই বলে জানায়। এ সময় আমি তাদেরকে বলি আমাকে নিয়ে চেয়ারম্যান যে সব কথা বলেছেন তা তাঁর নিকট আশা করিনি। এ সময় তাদের মধ্যে থেকে একজন আমাদের সম্প্রদায় তুলে আমাকে গালি দেয়। তারা আমার উপর হামলা চালায় ও মোটর সাইকেলটিও ভাংচুর করে।
এ প্রসঙ্গে নবীগঞ্জ থানার ওসি মো. মাসুক আলী বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৪৫ রাউন্ড টিয়ারশেল ও ১৫ রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়। এঘটনায় ওসি তদন্ত গোলাম মুর্শিদ, এসআই পরিমলসহ ৭জন আহত হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে, শহরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় উভয়পক্ষের ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় এখনো মামলা দায়ের হয়নি।
নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাইসুল হক তাহসিন, নিয়াল আহমেদ মাহি, মারুফ আহমেদ, মিনহাজ আহমেদ, মান্না আহমেদ, রাতুল আহমেদ, প্রান্তিক, রিহাদ, জুয়েল, সাফি, রিমন। এর সবাই নবীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী জাহিদ রুবেল গ্রুপের লোক। তবে থু থু ফেলা নিয়ে মনোমালিন্য ও দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তারা। প্রায় দুই মাস আগে ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী জাহিদ রুবেল আহত হয়ে বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ফলে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের প্রতিপক্ষের নেতা ছাত্রলীগ সদ্য বিলুপ্ত হওয়া কমিটির আহবায়ক নাজিমুদ্দৌলা চৌধুরী জাহিদ রুবেলকে কুপানোর মামলায় বর্তমানে জেলে রয়েছেন।