সেই নাসির এখনো কারাগারে
জালাল আহমেদ

চট্টগ্রাম বার এর সংখ্যাতাত্ত্বিক অবস্থান ঢাকা’র পরেই। ১৯৯১ সালে সদস্য সংখ্যা ১৫০০ এর উপর এবং তা বাড়তির দিকেই ছিল। তবে বাস্তবে যাদেরকে আমরা ভালো লইয়ার বলি এমন সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। দেওয়ানী আদালতের আইনজীবীদের আমরা খুব একটা চিনতাম না। ফৌজদারী আদালতে প্র্যাকটিস করা আইনজীবীদের মধ্যে বিশজনের বেশি ছিল না যাদেরকে ভালো বলা যায়। বেশিরভাগ আইনজীবী আসামীদের জামিন শুনানী পর্যন্তই একটিভ থাকেন। মামলা বিচার আদালতে গেলেই আর তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এখন আইনজীবীদের তেমন কারোরই নাম আর মনে নেই। জিয়া হাবিব আহসান হয়তো কিছু নাম মনে করিয়ে দেবেন।
মীরসরাই এর একেএম আমিনুল ইসলামের নাম মনে পড়ে, তিনি অত্যন্ত খ্যাতিমান আইনজীবী ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন। শুধু চিন্তা করে দেখেন এই সময়ে কতগুলো সরকার পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু সরকারি আইনজীবী বা পিপি এক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হয়নি।
আমাদের ছোটবেলায় হবিগঞ্জেও এমন দেখেছি। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া’র ভাই শাহ শামসুদ্দিন সাহেব স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে দীর্ঘদিন হবিগঞ্জের জিপি ছিলেন। পিপি আমিনুল ইসলাম সাহেব কখনো কখনো আমার কোর্টে আসতেন জামিনের শুনানী করতে। তিনি কেবল জামিনের পক্ষে আইনের উল্লেখযোগ্য পয়েন্টগুলো তুলে ধরতেন এবং শুনানী শেষে দাঁড়িয়ে অনুমতি নিয়ে বের হয়ে যেতেন। তিনি ফৌজদারী কার্যবিধি’র উপর চমৎকার একটি বড় আকারের বই লেখা শুরু করেছিলেন। ১৪৩ ধারা পর্যন্ত এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর আর প্রকাশিত হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন ভাষাসৈনিক বদিউল আলম। তিনিও অত্যন্ত আইন-কানুন জানা আইনজীবী ছিলেন। আদালতকে শ্রদ্ধা করতেন। রানা দাশগুপ্তও তখন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। আহসানুল হক হেনা তখন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী বিশেষ করে শুল্ক আইনের মামলায় প্রায় একচেটিয়া পসার। তবে তার ব্যবহার ভালো ছিল না বিশেষ করে আদালতের প্রতি তার আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
যা বলছিলাম এই সব ভালো এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মূলতঃ জামিনের আবেদন শুনানীতে আমার কোর্টে আসলেও বদিউল আলম, আহসানুল হক হেনা, রানা দাশগুপ্ত আমার আদালতে একাধিক বিচার মামলায় সাক্ষ্য গ্রহনের পর্যায়েও এসেছেন। তাঁদের ক্রস এক্সামিনেশন থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। তবে বিচার মামলায় একচেটিয়াভাবে যিনি সাক্ষীকে ক্রস এক্সামিনেশনে আনতেন তাঁর নাম আমি ভুলে গিয়েছি। তাঁকে বিশেষ করে নিয়োগ দেয়া হত সাক্ষীকে জেরা করার জন্য। যাকে বলে “আঁটি ভেংগে শাঁস খাওয়া” তিনি তাই করতেন। আদালতের জন্যও চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁকে যথাযথভাবে ট্র্যাকে রাখা। আমি মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম ১৯৯১-১৯৯৫ সাল, তখন দেশে ক্ষমতায় বিএনপি সরকার যদিও আমার পদায়ন হয়েছিল পূর্ববর্তী বিচারপতি শাহাবুদ্দিন এর কেয়ারটেকার সরকারের সময়। কামালউদ্দিন সাহেব পিপি ছিলেন। তখন চট্টগ্রাম বার এর নেতৃত্বে মূলতঃ আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা।
ইব্রাহিম চৌধুরী বাবুলের কথা মনে পড়ে। ফায়ারব্রান্ড এই প্রাক্তন ছাত্রনেতা বারের সম্পাদক ছিলেন আর সবসময়ই যে কোন বিষয়ে ছিলেন উচ্চকন্ঠ। ইফতেখার সাইমুম চৌধুরী ছিলেন তেমনই আরেকজন। জিয়া হাবিব আহসান তখন বদিউল আলম সাহেবের জুনিয়র হিসাবে আদালত অঙ্গনে পদচারণা শুরু করেছেন। শহিদুল হুদা নামে একজন উচ্চকন্ঠ আইনজীবী ছিলেন, পেশাগতভাবে খুব সফল বা দক্ষ না হলেও বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি কথা বলতেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনা’র গাড়িবহরে পুলিশের গুলি চালনায় ২৪ জন নিহত হবার ঘটনায় ১৯৯২ সালে তিনি মামলা করেন।
আদালতের বিষয়ে পত্রিকান্তরে সংবাদের কারণে সবাই ১৬৪ ধারার জবানবন্দী সম্পর্কে জানেন। কোন আসামী ধরা পড়লে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কখনো অপরাধ স্বীকার করে এবং আদালতের কাছেও অনুরূপ স্বীকারোক্তি প্রদানে রাজী হলে তাকে তার জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করার জন্য আদালতের কাছে নিয়ে আসা হয়। অন্যক্ষেত্রে কোন আসামী ধরা পড়লে মামলা তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তাকে কার্যবিধি অনুযায়ী রিমান্ডে নিয়ে থাকে। রিমান্ডে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, কখনো চোরাই মাল বা অন্য কিছু উদ্ধার করে এবং কখনো এর কোন এক পর্যায়ে আসামী আদালতের কাছে নিজেকে সম্পৃক্ত করে জবানবন্দী দিতে রাজী হয়।
সাধরণতঃ এই ধরণের আসামী নিয়ে আসা হলে সিএমএম কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে ন্যস্ত করেন এই জবানবন্দী লেখার জন্য। তেমনই এক আসামীকে একদিন আমার কাছে ন্যস্ত করা হল জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করতে। তার নাম নাসির, শিবিরের নাসির নামে তখন দেশজুড়ে কুখ্যাত পরিচিতি তার। আমার অফিস কক্ষে নিয়ে আসা হল তাকে। দেখি এই সেই যুবক যে ১ জুলাই সিডিএ ভবনের সামনে থেকে শুকতারা হোটেলের দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি চালাচ্ছিল। আমার রুমের এক কোনে তাকে বসিয়ে রাখলাম। আমার রুম ছিল নিরাপদ, ঢুকতে হত কোর্ট রুম হয়ে, অন্য কোন দরজা ছিলো না। তাকে রিফ্লেকশন এর জন্য তিন/চার ঘন্টা সময় দেবার পর তার সংগে কথা শুরু করলাম, বিধি অনুযায়ী তাকে নিজের পরিচয় দিলাম, জবানবন্দী না দিলে তাকে আর পুলিশের কাছে দেয়া হবে না একথা বললাম, জবানবন্দী দিতে সে বাধ্য নয় একথা বললাম এবং জবানবন্দী তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যে ব্যবহৃত হতে পারে একথাও জানালাম। তারপর নাসির তার কথা বলতে শুরু করলো। নাসিরের বাড়ি ফটিকছড়ি এবং শিবিরে রিক্রুট হবার পর যখন কিছু ঘটনার জন্য সে পুলিশের নজরে পড়ে তখন তাকে দুবাই পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৪ সালেই তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় দেশে। এরপর সে শিবিরের স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে অংশ নেয়। কেন সে ফিরে আসলো জিজ্ঞেস করায় বললো যে সে বাধ্য হয়েছে ফিরে আসতে কারণ দলই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে কাঁদতে থাকলো কথা বলতে বলতে। তখনো তার বিরুদ্ধে তেমন কোন সিরিয়াস মামলা নাই যদিও শিবির ক্যাডারদের মাঝে সে তখনই বিখ্যাত। এর কিছুদিন পরই সে জামিনে মুক্তি পায় এবং ১৯৯৮ সালে আবার গ্রেপ্তার হয়। তারপর থেকে এখনো সে কারাগারে আছে।