জালাল আহমেদ
অত্যন্ত প্রভাবশালী সচিব মোকাম্মেল হক ভূমি সচিব হিসাবে ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিলেন
বাসায় ফিরে ঝড়কে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। হ্যারিকেনগুলো সব পরিষ্কার করে তেল ভরে রাখা হলো আর জানালাগুলো যতদূর সম্ভব গ্রীলের সংগে বেঁধে রাখলাম। আমাদের বাসা ছিল নিরাপদ জায়গায়, পাহাড়ের ঢালে। সামনে পূর্বপাশে উত্তর দক্ষিণ রাস্তা, পশ্চিমপাশে পাহাড়, এক ফ্লোর লেভেল উঁচুতে চট্টগ্রাম কলেজের টিচার্স কোয়ার্টার, উত্তর-দক্ষিণ দু’পাশেই বিল্ডিং। সন্ধ্যার পর থেকে বাতাস বাড়তে শুরু করলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা রূপ নিল ঝড়ো হাওয়ায়, আর যথারীতি বিদ্যুৎও গেল। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে অন্ধকার বাসায় বসে আছি। আমার বড় ছেলে আসিফ আহমেদ ভিক্টর তখন একদম ছোট! রাত ১০টার পর বাতাস গেলো আরো বেড়ে, প্রচন্ড শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস পেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিল্ডিং এর উপর দিয়ে, পাশ দিয়ে। আমার অভিজ্ঞতায় এমন প্রচন্ড বাতাস বা তার গোঁ গোঁ শব্দের কোন তুলনা নেই। এদিকে চারপাশ গরম হয়ে উঠেছে, রীতিমত গরম লাগছে।
এরমাঝে বাড়তি বেডরুমের একটা জানালা খুলে গেল। দৌঁড়ে ওই রুমে গিয়ে গ্রীলের ভেতর দিয়ে হাত বের করে কোনরকম যুদ্ধ করে জানালাটা বন্ধ করতে সক্ষম হলাম, আবার বেঁধে দিলাম। এই করতে গিয়ে কখন যে হাতে আঘাত পেয়েছি টেরও পাইনি। একটু পরে হাতের উপরের অংশে ব্যাথা করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাতাস কমতে শুরু করলো। কমতে কমতে শূন্যের কোঠায়। বই পড়া বিদ্যা ও আমাদের উপর তলার এক জাহাজী প্রতিবেশী থেকে ধার করা বিদ্যা থেকে বুঝতে পারছিলাম যে তখন আমরা ঝড়ের কেন্দ্রে রয়েছি। ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড় তার কেন্দ্র চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করে যায়। মাসুদ রানা পড়া বিদ্যা থেকে জানি যে সমুদ্রের ঝড়ে জাহাজ অনেক সময় ঝড়ের কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে ঝড়ের সংগে মুভ করে ও ঝড় দুর্বল হলে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসে।
অল্পক্ষনের মধ্যেই এই নিস্তব্ধতা কেটে যেতে লাগলো, বাতাসের গতি আবার বাড়তে শুরু করলো। শত দানবের শক্তিতে যেন আবার ঝাঁপিয়ে পড়লো চট্টগ্রামের বুকে।
আমি ভাবছিলাম ৭০ এর গোর্কিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত চর কুকরীমুকরী আর ভোলার কথা। মনে পড়ছিল কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা আর সন্দীপের মানুষজনদের কথা। সবচেয়ে দীর্ঘরাতও এক সময়ে শেষ হয়, তেমনি শেষ হল প্রলয়ংকরী এই ঘূর্ণিঝড়। রাত তিনটার দিকে চারিদিক শান্ত হয়ে আসতে থাকে যদিও সকাল পর্যন্ত বাতাসের দাপট ছিল প্রবল। সকালে যখন দরজা খুলে সামনে বের হই তখনো ধ্বংসলীলার পরিমাণ বুঝিনি। নিরাপদে থাকার উদাহরণ দিতে গিয়ে মায়ের উদরে থাকার একটা উদাহরণ দেয়া হয় আমরা যেন ছিলাম তাই। দক্ষিন পশ্চিম থেকে আসা বাতাসের মুখে আমরা ছিলাম পারসিভিল হিলের পূর্ব ঢালে ফলে বাতাসের তেমন কোন চাপই আমাদের উপরে ছিল না, তাতেই এই! অন্যত্র কি অবস্থা বুঝতে পারছিলাম না। অফিস যাবার জন্য গাড়ি আসবে না এটা বুঝতে পারছিলাম তাই যথাসময়ে পায়ে হেঁটে অফিসের পথে রওনা হলাম।
পাহাড় থেকে নেমে ডানে মোড় নিতেই চোখে পড়তে লাগলো ধ্বংসলীলার চিত্র। আশেপাশের কোন গাছ আর অক্ষত নাই। চট্টগ্রাম কলেজ, গনি বেকারী, কুখ্যাত গুডস হিল পার হয়ে রহমতগঞ্জের রাস্তায় কোর্ট বিল্ডিং এর দিকে যেতে লাগলাম। শীতের শেষে গুহা থেকে মাথা বের করার মত মানুষজনও বেরিয়ে আসছিল রাস্তায়। পুরো রাস্তা জুড়ে গাছপালা পড়ে আছে, গাছপালার ভাঙা ডাল ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে আমরা এগুচ্ছি। একটা বিশেষ অবস্থা চোখে পড়লো যে প্রায় সব গাছের পাতা পুড়ে গেছে। পুরো রাস্তার দু’পাশে কোন গাছের গায়ে অবিমিশ্র সবুজ পাতা নেই। ঝড়ের দাপটে ঘর্ষণে সব পাতা পুড়ে গিয়েছে, এ দৃশ্য অভূতপূর্ব। একসময় লালদিঘী পার হয়ে পাহাড় বেয়ে কোর্ট বিল্ডিং এ উঠলাম। নিজের এজলাশে গিয়ে দেখলাম দরজা জানালার অনেক কাঁচ ভেঙ্গে পড়ে আছে, তখনো পেশকার বা অন্যরা আসে নাই, সিএমএম সাহেবও না।
দোতলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উঠে এডিসি (জেনারেল) মোঃ আফজাল হোসাইনকে পেলাম। তিনি চেষ্টা করছেন ঢাকায় কথা বলতে কিন্তু কোন ফোন ঠিক নেই। কেউ একজন পরামর্শ দিল যে সিআরবি বিল্ডিং মানে রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারের অফিস থেকে সংযোগ পাওয়া যেতে পারে। আমরা কয়েকজন পায়ে হেঁটে সিআরবি বিল্ডিং এর দিকে রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে জিএম এর রুম থেকে এডিসি সাহেব ঢাকায় রিপোর্ট করলেন কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে এই সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। চট্টগ্রামে কোথাও আর টিএন্ডটি ফোন সচল ছিল না। আমরা ফিরে এলাম কোর্ট বিল্ডিং এ, জেলা প্রশাসক এআর খানের রুমে বসা হল। সিদ্ধান্ত হল একটা স্টক টেকিং এর চেস্টা করা হবে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দিকে বের হবে এবং ক্ষয়ক্ষতির একটা অনুমান বা এস্টিমেশন করার চেষ্টা করবেন।
আমি একদলের সংগে বের হয়ে পড়লাম। আমার যে অন্য একটা অফিস আছে বা আদালত আছে, অন্য একজন নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা আছে তা বেমালুম ভুলে বের হয়ে পড়লাম পতেঙ্গার দিকে। থেমে থেমে গাড়ি যাচ্ছে, স্থানীয়ভাবে, সিটি করপোরেশন, সড়ক বিভাগ, নৌবাহিনী রাস্তা পরিস্কারের চেষ্টা করছে। নদীর পাড় ধরে এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগুতে গিয়ে আটকে গেলাম জাহাজে! রাস্তার মাঝখানে এক জলযান বসে আছে, প্রবল জলোচ্ছ্বাস তাকে তুলে এনেছে রাস্তার উপর, রাস্তা বন্ধ। এরমাঝেই চোখে পড়লো নদীর পাড় জুড়ে মানুষ ও গবাদীপশুর মৃতদেহ। ওখান থেকে ফিরে এসে অন্য রাস্তায় চেষ্টা করলাম পতেংগা পৌঁছানোর। বিমানবাহিনী চেষ্টা করছিল দ্রুত এয়ারপোর্ট ব্যবহারোপযোগী করার। তখন ১০ বছর সামরিক শাসন পরবর্তী অনভিজ্ঞ নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। তাদের পক্ষে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া বা ব্যবস্থাপনা করা কঠিন ছিল। কিন্তু বাস্তবে ১৯৯১ এর ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ছিল সবচেয়ে ভালোগুলোর একটা। যার তুলনা চলে ১৯৯৮ সালের বন্যা ত্রাণ ব্যবস্থাপনার সাথে।
অনভিজ্ঞ সরকারও অত্যন্ত দ্রুত ব্যবস্থা নিল অন্ততঃ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে। সরকার একজন জোনাল রিলিফ কোঅর্ডিনেটর বা আঞ্চলিক ত্রাণ সমন্বয়কারী নিয়োগ দিলেন কোন বিস্তারিত টার্মস অফ রেফারেন্স ছাড়াই। তারা এ কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে পেরেছিলেন। মোকাম্মেল হক, ১৯৬০ ব্যাচের সিএসপি, পরীক্ষায় সারা পাকিস্তানে যিনি প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর পিতা ‘জাতীয় মংগলের কবি’ বলে খ্যাত মোজাম্মেল হক। মোকাম্মেল হক আমলা হিসাবে অত্যন্ত খ্যাত, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক ছিলেন, তমঘায়ে কায়েদে আজম পেয়েছিলেন। মোকাম্মেল হক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর সামরিক শাসনের শেষদিকে এসে অত্যন্ত প্রভাবশালী সচিব ছিলেন। ভূমি সচিব হিসাবে ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনও তিনি এনেছিলেন। ফলতঃ নতুন সরকারে তিনি অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। তিনি তখন সরকারের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
মোকাম্মেল হক যখন চট্টগ্রামে আসেন তখন তিনি জানতেন না কি করতে হবে কারণ কোন টার্মস অফ রেফারেন্স ছিল না। কিন্তু তিনি যা জানতেন অনেকে তা জানতো না। মোকাম্মেল হক শূন্য থেকে কাজ বানাতে পারতেন! আর মোকাম্মেল হকের অভিজ্ঞতা ছিল ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ করার। এই অভিজ্ঞতার বিশেষত্ব ছিল যে ঐ ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলা এবং মোকাম্মেল হক ভোলা’র সন্তান। তিনি নিজে ভলান্টিয়ার করলেন ঐ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে যোগ দেবার। ১৯৭০ সালের ইপিসিএস ব্যাচ তখন বিভিন্ন জেলায় সংযুক্তি প্রশিক্ষণে। এই ব্যাচের সব তরুণ অফিসারদের লাগিয়ে দেয়া হল ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে। এই অভিজ্ঞতা পেইড অফ করলো ১৯৯১ সালে!