জালাল আহমেদ
আমি যখন জেলা প্রশাসক বা সিএমএম ছিলাম তখনো হাসিমুখে রিগ্রেট করা আর যারা সম্মানের আসনে তাঁদের সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করিনি
চট্টগ্রাম শহরে তুলশীধাম অনেকেরই পরিচিত, শহরের নন্দনকানন, স্বর্গের বাগান এলাকায়, বিটিসিএল এর স্থাপনা’র কাছেই। সেই তুলশীধামে যে সাধু’র সমাধি, শ্রীমৎ অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ, তাঁর সাধনপীঠ বাঁশখালী উপজেলায়, রামদাস মুন্সী’র হাটের কাছেই ঋষিধামে। মোট ২৯ একর পাহাড়ি জমির উপর এই আশ্রম, চারিদিকে পান্নাসবুজ ঘাস আর গাছগাছালি। এই আশ্রমের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। আশ্রমে প্রতি তিনবছর পর পর কুম্ভমেলার প্রচলন করেন তিনি। ফলে প্রতি তিনবছরে একবার ভক্তদের মহা সমাবেশ হত এখানে। আর রামদাসমুন্সী’র হাট ছিল উপজেলার অন্যতম বড় বাজার। এ ধরণের অন্য যে কোন আশ্রমের মতোই এখানেও সেবায়েত ও সাধুদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিলতা ছিল। তবে কমিটির সভা থাকুক বা না থাকুক, আমি অনেক সময়ই সেই আশ্রমের শান্ত নীরবতায় সময় কাটাতে গিয়েছি, গিয়েছি নগরীর তুলশীধামেও। সেবায়েত পরিবারের সংগে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায় যা অনেককাল অক্ষুন্ন ছিল।
এর মাঝে শীত আসি আসি করছে, উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে আমার অফিসের সামনে ব্যাডমিন্টন কোর্ট করা হল, নিয়মিত খেলতেও শুরু করলাম। অন্য অফিসাররাও খেলতে আসতো। আমার সংগে সহকারী কমিশনার ছিল দুইজন, উপজেলা পরিষদের শামসুল আরেফিন, কয়েকদিন আগে সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ছিল মোঃ রফিকুল আলম। তাঁরা উভয়েই ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। এর মধ্যে আরেফিন গিয়েছিল আইন ও প্রশাসন কোর্সে। সেখানে প্রশিক্ষণার্থীদেরকে তাঁদের প্রিয় কর্মকর্তা সম্পর্কে লিখতে বলা হলে শামসুল আরেফিন আমার সম্পর্কে চার পৃষ্ঠার চমৎকার একটি লেখা জমা দেয় একাডেমীতে। যা মহাপরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল আলম আলাদাভাবে আমার কাছে প্রেরণ করলে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। কারণ আমার এমন সব গুনের কথা আরেফিন লিখেছিল যা অর্জনের জন্য বাকি জীবন আমি চেষ্টা করে গিয়েছি।
আমার সংগে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতো অঞ্জনা ভট্টাচার্য। অঞ্জনা বানীগ্রামের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তাঁর ভাইয়ের কথা আগেও উল্লেখ করেছি, অধ্যাপক হিমাংশু বিমল ভট্টাচার্য। আমি বানীগ্রামে অঞ্জনাদের বাড়িতেও গিয়েছি দুর্গাপূজার সময়, তাঁদের বাড়ির প্রতিমা গাঢ় নীল রঙের ছিল। তখন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নতুন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাদের প্রথম ব্যাচ মাত্র মাঠে এসেছে। তাঁদের কাজের পরিধি এবং আওতাও স্পষ্ট নয়। এরমাঝেও অঞ্জনা অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে কাজ করতো, নিজে কাজের সুযোগ তৈরী করতো এবং আমার জন্যও কাজ বানিয়ে নিয়ে আসতো। অঞ্জনা এবং তাঁর ভাই হিমাংশু বাবুর সংগে আমার এখনো যোগাযোগ রয়েছে।
সংসদ সদস্যের গ্রাম বৈলছড়ি সংলগ্ন চেচুড়িয়া গ্রাম এর চেচুড়িয়া যুবসংঘ অত্যন্ত একটিভ একটি সংগঠন ছিল। তারা প্রতিবছর তাদের গ্রামে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের আয়োজন করে থাকে। এই যুবসংঘ মূলতঃ খেলাধুলা এবং যুব সমাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদানের জন্য আমাকে ‘ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ ঘোষনা করলো যা স্বভাবতঃই সংসদ সদস্যের পছন্দ হলো না। কিন্তু কিছু করার নাই ইতোমধ্যে আমাকে সরানোর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তখন ইউএনও পদায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি ছিল। সে কমিটিকে এপ্রোচ করা হলে বলা হলো যে ইউএনও এর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তা দেন, আমরা তদন্ত করে দোষ পেলে ব্যবস্থা নিব কিন্তু বদলী করা হবেনা। ফলে নভেম্বর মাসে ‘কুঁ’ড়া’ ইসহাক জানালো যে এমপি সাহেব আমাকে বদলী করার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছেন।
এখানে আরো একটি নিউট্রালাইজিং বিষয় ছিল। এমপি সাহেবের আপন ভাতিজা ছিল আমার অফিস সুপার রাশেদ আহমদ চৌধুরী আর তাঁর আপন ভাগিনা ছিল অফিস সহকারী কমরুর রশিদ চৌধুরী। ফলে পরিবারে তিনি আমার সম্পর্কে কিছু বললেই তাঁরা আমাকে সমর্থন করতো এবং চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন চৌধুরীও আমার পক্ষে কথা বলতেন। তাঁর বড় ভাই ওলিউল ইসলাম সুক্কু মিয়াও আমাকে পছন্দ করতেন। একই সময়ে সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে সরকার নবগঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর প্রশাসক নিযুক্ত করলেন এবং তাঁকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা প্রদান করলেন। ফলে তিনি চট্টগ্রামে নগর প্রশাসন ও মহানগরের রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেশি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নগর প্রশাসককে ডিসেম্বর ১৯৮৮ তে একটি সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং তিনি প্রথমবারের মত আমার বাসায় আসেন ও নৈশভোজে অংশ নেন।
তারপরও খুদুকখালি এবং অন্যান্য ইস্যুতে সংসদ সদস্যের সংগে মতানৈক্য চলতেই থাকে। চট্টগ্রামে আমার প্রথম জেলা প্রশাসক, আগে উল্লেখ করেছি, এম এ মান্নান স্যার (বর্তমান পরিকল্পনা মন্ত্রী)। কিছুদিন পর স্যারের কাছে অভিযোগ করলেন নগর প্রশাসক ও সংসদ সদস্য। একদিন সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের ডিসি হিলের বাংলোতে বসলাম, সংসদ সদস্যও আসলেন। অভিযোগ ছিল যে আমি তাঁকে ফোন করি না ২৯ দিন, চট্টগ্রাম শহরে আমি আসি যাই কিন্তু তাঁর সংগে দেখা করি না। তৃতীয় অভিযোগ হল যে আমি তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করি না। আমি বললাম যে স্যার, উপজেলার কমিটিগুলোতে সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি আছে, কোন বক্তব্য থাকলে সেখানে তাঁরা বলে থাকেন। আমার যদি প্রয়োজন থাকে তবে আমি নিশ্চয়ই ফোন করবো, তাঁর প্রয়োজন হলে তিনি করবেন। তখন গুচ্ছগ্রাম কমিটি, খাস জমি বরাদ্দ কমিটিসহ আরো কয়েকটি কমিটিতে সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি থাকার সুযোগ ছিল। আমি আরো বললাম যে আমি চট্টগ্রামে আসি সভায় যোগ দিতে এবং ফিরে যাই, তিনি নগর প্রশাসক, ব্যস্ত মানুষ, আমি তাঁর ব্যস্ত শিডিউলে অনামন্ত্রিত ঢুকতে চাই না। তৃতীয় অভিযোগের কোন জবাব আমি দেইনি।
তবে আমি সবসময়ই, এমনকি যখন জেলা প্রশাসক বা সিএমএম ঢাকা ছিলাম তখনো হাসিমুখে রিগ্রেট করা আর যারা সম্মানের আসনে তাঁদের সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করি নাই। এটা আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে যারা আমাদের সেবা চায় তাঁদের সংগে সদ্ব্যবহার করা। ব্যবহারের কারণে যেন কেউ ক্ষুব্ধ না হন। আবার কোনটা উপেক্ষা করতে হবে তাও বুঝতে হবে। অর্থাৎ অতি স্পর্শকাতর হওয়া যাবে না।
এরপর আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সামনে মতানৈক্যের মূল ইস্যুগুলো নিয়ে বললাম, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর কাজ পরিমাপ, উপজেলা’র বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, খুদুকখালী, উপজেলা চেয়ারম্যান ও অন্যান্য বিষয়। জেলা প্রশাসক সংসদ সদস্যের সামনে আমাকে কি করতে হবে পরামর্শ দিলেন। সংসদ সদস্য চলে যাবার পর বললেন ‘তুমি কোন মিশনারী না, দুনিয়াকে পাপমুক্ত করার জন্যও তোমার আগমন ঘটেনি’ এবং ‘কেউ যদি তোমাকে ওভারটেক করতে চায়, ভেঁপু বাজায়, সাইড দাও, পরে সুবিধামতো তাঁকে ওভারটেক করো, দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিও না’। পরেও এই সমস্যা রয়েই গেলো, কিন্তু যেহেতু আমার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার মতো কিছু ছিল না, এভাবেই চলছিল।
পরবর্তী জেলা প্রশাসক তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রামে ১৯৭৮-১৯৮১ সময়কালে তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন। ১৯৮৯ তে তিনি জেলা প্রশাসক হিসাবে এলেন রংপুর থেকে। বলা হয়ে থাকে যে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মা যখন মারা যান তখন যারা সবচেয়ে বেশি কান্নকাটি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। তোফায়েল আহমেদ চৌধুরীও আমাকে ডাকলেন। সমস্যা একই, বললেন যে তিনি যখন এডিসি চট্টগ্রাম, তখন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট, কিন্তু এখন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় মেয়র বিধায় ডিসি হিসাবে তাঁর সংগে ভারসাম্য রক্ষা করেই কাজ করতে হচ্ছে। তাই আমাকেও ধৈর্য ও ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করার পরামর্শ দিলেন।