জালাল আহমেদ
আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর দায়িত্ব গ্রহণ করি ২৭ বছর ৫ মাস বয়সে

জিইসি মোড়ের ওয়াংচাই রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে আমি এগিয়ে দিতে আসা ১৯৮৫ ব্যাচের দুই অফিসার জিয়াউদ্দিন আহমদ ও কামালউদ্দিন তালুকদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাঁশখালী’র গাড়িতে উঠলাম। চালকের নাম জামাল, আমার দেখা অন্যতম স্মার্ট এবং ভালো ড্রাইভার। আমরা রওয়ানা হলাম বাঁশখালী’র পথে। পরে সে আমাকে বলেছিল যে যখন তার গাড়িতে উঠলাম তখন সে নিশ্চিত হলো যে আমিই তার ইউএনও। এর আগে তিনজনের মধ্যে কোন জন ইউএনও এটা নিয়ে সে বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। বহদ্দারহাট, কালুরঘাট সেতু, পটিয়া, কেরানীরহাট পর্যন্ত আমার চেনা, তারপর গাড়ি ডানে মোড় নিয়ে ঢুকলো সাতকানিয়া উপজেলার রাস্তায়। কেরানীরহাট পর্যন্ত ৩০ মাইল ভালো রাস্তা। তারপর সাতকানিয়া পর্যন্ত ২/৩ মাইল ডলু ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা ব্ল্যাক টপ। এরপর শুরু ইট বিছানো, হেরিং মাছের কাঁটা’র মত রাস্তা। কোথাও বড় ঢেউ, কোথাও ছোট ঢেউ, কোথাও কেউ ইট তুলে নিয়ে বাড়িতে খাটের পায়ার নীচে দিয়েছে, খাগড়াছড়ি রাস্তার কথা মনে করিয়ে দিল। এরপর কালীপুর-বৈলছড়ি-জলদী বাজার হয়ে ২ ঘন্টা ৪০ মিনিটে বাঁশখালী পৌঁছে সরাসরি অফিসে।
তখন দায়িত্বে ছিলেন ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদউল্লাহ, তিনি দায়িত্বমুক্ত হলেন। আমি বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর দায়িত্ব গ্রহণ করি ৬ জুন ১৯৮৮ তারিখে ২৭ বছর ৫ মাস বয়সে। এখানে উল্লেখ্য ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচ থেকে আমিই প্রথম ইউএনও পদে যোগদান করি। বলতে আপত্তি নেই যে বাঁশখালী পোস্টিং হয়ে আমার মন একটু খারাপ হয়েছিল কিন্তু বিশেষ করে ড. সা’দত এর সংগে দেখা করে আসার পর এর ভালো দিক নিয়ে ভাবতে থাকি। বাঁশখালী ছিল একটি বিশেষ ধরনের উপজেলা, একে স্থানীয়ভাবে ছোট আরাকান বলা হত। এর মূল কারণ ছিল বাঁশখালী’র দুর্গম অবস্থান। প্রায় ৪০০ বর্গ কিলমিটারের এই উপজেলার উত্তরে সাংগু নদী পার হয়ে আনোয়ারা। পূর্বে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা পাহাড় দ্বারা বিচ্ছিন্ন, দক্ষিনে পেকুয়া ও চকরিয়া মাতামুহুরী নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং পশ্চিমে কুতুবদিয়া চ্যানেল ও বঙ্গোপসাগর।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এর সংস্কৃতিও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শিক্ষার হার কম, মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি, অধিক রক্ষনশীল। বাঁশখালী উপজেলা উত্তরে দক্ষিণে প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা, পূর্বে-পশ্চিমে ৭-১০ কিলোমিটার চওড়া। উপজেলার পশ্চিমাংশ আবার জলকদর খাল দিয়ে বিচ্ছিন্ন। জলকদর খালের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের মধ্যেও শিক্ষার হারের অনেক তারতম্য ছিল। উপজেলায় ইউনিয়ন ছিল ১৫ টি, জনসংখ্যা এখন সাড়ে চারলাখ, যে কোন বিবেচনায় একটি বড় উপজেলা। বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ঐতিহ্যবাহী পরিবারের, যারা বংশানুক্রমিক ভাবে চেয়ারম্যান। একটি ইউনিয়নে তো পরিবার থেকে ঠিক করা রোটেশনে একজনের পর একজন চেয়ারম্যান হতেন। বাঁশখালী একই সংগে একটি সম্পদশালী উপজেলাও ছিল। একই জমিতে শীতকালে লবন এবং বর্ষাকালে চিংড়ি চাষ হত। জমি ছিল উর্বরা, পাহাড় থেকে বয়ে যাওয়া ছড়ার পানিতে চাষ। ধান ভালো হত এবং প্রচুর বরবটি করল্লা উপজেলার বাইরে যেত। এছাড়া ডাব এবং অত্যন্ত উঁচুমানের তরমুজ উৎপাদিত হতো যার চাহিদা ছিল সর্বত্র।
সেখানে না গেলে আমার জানা হত না আর এখন ধারনা করাও সম্ভব না তখন কি পরিমাণ সিগারেট, ভিসিআর ও ভিসিপি চোরাচালান হয়ে দেশে ঢুকতো। বাঁশখালী উপজেলা এবং তার উপকূল ছিল সেই চোরাচালানের এক প্রধান রুট। বাঁশখালী উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন সুজিত কান্তি শিকদার। তিনি কিছুদিন আগের উপনির্বাচনে বিজয়ী হবার আগে সদর ইউনিয়ন জলদী’র চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদে সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান। তার মানে আমি যাবার অল্পদিন আগেই সুজিত শিকদার উপনির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তখনকার সময়ে বাঁশখালী ছিল “হটসিট ফর ইউএনওস”, ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে উদ্বোধন করা এই উপজেলার আমি ছিলাম ষষ্ঠ ইউএনও এবং উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা তিন দফায় ১০ মাস দায়িত্ব পালন করেছেন।
দুর্গম এই উপজেলায় পৌঁছে স্বভাবতই একটু দমে গিয়েছিলাম। তবে খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, ফরিদগঞ্জের মত জায়গায় দায়িত্ব পালন করে এসেছি বলে আত্মবিশ্বাসও ছিল মনে। কিন্তু একের পর এক ইউএনও বদলের চিত্র দেখে প্রথমে একটু দমে যাই। কারণ আমার কোন মুরুব্বী ধরার অভ্যাস ছিল না আর কোন মুরুব্বী ছিলও না। ফলে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জিং হবে এটা প্রথম দিনই বুঝতে পারি এবং উপজেলার জনগণই হবে আমার প্রধান শক্তি তাও উপলদ্ধি করতে পারি।
বাঁশখালী উপজেলার প্রথম ইউএনও ১৯৭৩ ব্যাচের এজেএম সালাহউদ্দিন আহমেদ ১১.৪.৮৩ থেকে ২৬.৬.৮৪ পর্যন্ত এই উপজেলায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর কথা আগে এক জায়গায় উল্লেখ করেছিলাম যে ঢাকা সদর সাউথ মানে ঢাকা মহানগরীর মহকুমা প্রশাসক থেকে তাঁকে বাঁশখালী পোস্টিং দেয়া হয়েছিল। তিনি পরে বাঁশখালী থেকেই সাময়িক বরখাস্ত হন। এরপর ইউএনও ছিলেন ১৯৭৩ ব্যাচের মোহাম্মদ হাসান, রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসাবে তাঁকে অনেকেই চেনেন। তিনি ইউএনও ছিলেন ২৭.৬.৮৪ থেকে ৩০.৬.৮৫ পর্যন্ত এবং চট্টগ্রামে বসে তিনি উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্বভার হস্তান্তর করেন। পরবর্তী ইউএনও ১৯৭৩ ব্যাচের মোঃ শোয়েবুর রহমান ১.১১.৮৫ থেকে ১১.৫.৮৬ পর্যন্ত বাঁশখালীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি পরে আমার সংগে চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ও পরে আমার নিজ জেলা হবিগঞ্জে এডিসি ছিলেন।
এরপর ১২.৫.৮৬ থেকে ১৮.৪.৮৭ পর্যন্ত ইউএনও ছিলেন ১৯৮১ ব্যাচের এম.আরিফুল হক ভূঁইয়া। তিনি এখান থেকে ইউএনও হিসেবে মীরসরাই বদলী হন। এরপরের ইউএনও এবিএম শফিকুল ইসলাম, প্রাক্তন সার্কেল অফিসার। ভালো অফিসার ছিলেন, ইউএনও ছিলেন ৬.৫.৮৭ থেকে ১.৩.৮৮ পর্যন্ত। তিনি বদলী হয়ে যান পাশের উপজেলা লোহাগাড়ায়। পরবর্তী দু’জনের সংগেই এক জেলায় কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। হাসান সাহেবও চট্টগ্রামের এডিসি ছিলেন। তাই ৬ জুন ১৯৮৮ এখানে যোগদান করেই বুঝতে পারি যে ‘এ বড় কঠিন ঠাঁই’! আমার সুবিধা ছিল যে আমার কোন পারসোনাল এজেন্ডা ছিল না আর আমি ব্যাচেলর, বদলী হলে ব্রিফকেস হাতেই চলে যাবো।