আদালতে গর্ভধারীনি মায়ের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী

এসএম সুরুজ আলী ॥ পরকীয়া প্রেমিককে কাছে পেতে জুসের সাথে বিষপান করিয়ে নিজের ৩ শিশু সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছিল পাষান্ড মা ফাহিমা খাতুন (২৮)। ১ সন্তান মারা গেলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ২ সন্তান। গতকাল মঙ্গলবার হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন ফাহিমা খাতুন। আদালতে স্বীকারোক্তি প্রদান শেষে ফাহিমাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। রাতে এক প্রেস বিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ফাহিমার স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, দীর্ঘদিন ধরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের উচাইল-চারিনাও গ্রামের টমটম চালক সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের সাথে পাশ্ববর্তী বাড়ির আক্তার মিয়ার পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। একাধিক বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ আক্তার মিয়ার সাথে ফাহিমা আক্তারের স্বামী সিরাজুল ইসলামের গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। এ সম্পর্কের সুবাদে ফাহিমার বাড়িতে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতো আক্তার মিয়া। তার বাড়িতে আক্তারের চা নাস্তা খাওয়া ছিলো নিত্যদিনের। কিন্তু নারীলোভী আক্তার বন্ধুত্বের আড়ালে সিরাজুলের স্ত্রীর সাথে পরকীয়া অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। এক পর্যায়ে আক্তার মিয়া ফাহিমা খাতুনকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। ঘটনার ৩/৪মাস পূর্বে আক্তার মিয়া ফাহিমা খাতুনকে হবিগঞ্জ শহরে এনে তার স্বামী সিরাজুলকে এফিডেভিটের মাধ্যমে ডিভোর্স দেয়ার চেষ্টা করলে সিরাজুল বিষয়টি আঁচ করতে পারে। এ সময় ফাহিমা সিরাজুলকে ডিভোর্স দিতে পারেনি। কিন্তু ফাহিমা আক্তারের সাথে পরকীয়া চালিয়ে যায় আক্তার। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ফাহিমার ৩ সন্তান। তাই আক্তারকে নিয়ে নিজের ৩ শিশু সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করে ফাহিমা। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের দোকান থেকে ফাহিমা ২টি লিচুর জুস ক্রয় করে এনে প্রেমিক আক্তার মিয়ার হাতে দেয়। আক্তার মিয়া জুসে বিষ দেয়। পরবর্তীতে আক্তার মিয়া ও ফাহিমা খাতুন তার ৩ সন্তানকে উঠান থেকে ডেকে এনে জুস খাইয়ে দেয়। এ সময় আক্তার মিয়া কৌশলে কেটে পড়ে। বিষক্রিয়ায় পাষান্ড ফাহিমার ৩ শিশু সন্তান অশান্তি ও ছটফট করতে থাকে। তাদের কান্না চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে অভিনয়ের ছলে মায়া কান্না শুরু করে পাষান্ড মা ফাহিমা। এ সময় এলাকাবাসীর সহায়তায় বিষাক্রান্ত ৩ শিশুকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্মরত চিকিৎসক ফাহিমার ৭ বছরের শিশুকন্যা সাথী আক্তারকে মৃত ঘোষণা করেন। আর আশংকাজনক অবস্থায় তার শিশুপুত্র তোফাজ্জল ইসলাম (১০) ও রবিউল ইসলাম (৬)কে সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা নেয়ার পর তোফাজ্জল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম সুস্থ হয়। পরে ফাহিমা ও আক্তারের পরকিয়া প্রেমের বিষয়টি প্রকাশ পায়।
এ ঘটনায় স্বামী সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে স্ত্রী ফাহিমা আক্তার, শ্বশুর মুতি মিয়া, শাশুড়ি নাজমা আক্তারকে আসামী করে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য হবিগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়। পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী, এসআই মন্তোষ চন্দ্র দাস, এসআই পার্থ রঞ্জন চক্রবর্তী তদন্ত শুরু করেন। তদন্তে নিহত শিশু সাথী আক্তারের মা ফাহিমা খাতুনের কথাবার্তা ও আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ফাহিমা গ্রেফতারের পরই গা ঢাকা দেয় তার পরকীয়া প্রেমিক আক্তার মিয়া। কিন্তু এসআই নামজুল হক মামলাটি তদন্ত অব্যাহত রাখেন।
প্রেস ব্রিফিংকালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো বলেন- পাষান্ড মা ফাহিমা গ্রেফতারের পর কারাগারে গিয়ে আক্তার মিয়া ফাহিমার সাথে দেখা করে এবং এ ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা গোপন রাখার অনুরোধ করে। এই অনুরোধে পরকীয়া প্রেমিককে বাঁচাতে প্রথমে মুখ খুলতে চায়নি ফাহিমা। এদিকে মামলার রহস্য উদঘাটনের জন্য পুলিশ আদালতে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এ প্রেক্ষিতে তাকে ৩দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে ফাহিমা নিজের ৩ সন্তানকে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করে। রিমান্ড শেষে গতকাল বিকেলে তাকে আদালতে নিয়ে গেলে সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। প্রেস ব্রিফিংকালে উপস্থিত ছিলেন হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মাসুক আলী।