জালাল আহমেদ
একটি পরীক্ষায় খারাপ করা মানে জীবনের শেষ নয়, সুযোগের অনেকগুলো দরজা সামনে থাকে

আমি রাতে সাধারণতঃ চার থেকে পাঁচ ঘন্টা পড়তাম। রাত ৮টায় শুরু করে রাত ১টা বা ২টা পর্যন্ত। সকালে ২/৩ ঘন্টা পড়া হতো তবে খুব সিরিয়াসলি না। আর আমার পড়ার বইয়ের বাইরে পড়ার যে অভ্যাস তা তখনো অব্যাহত, সুযোগ করে নিয়ে ফাঁকে ফাঁকে মাসুদ রানা বা অন্য কিছু। এটা সবার জন্য উপযোগী না এবং এ পরামর্শও আমি দিচ্ছি না। এতে আমার খুব একটা ক্ষতি হয়েছে বলে আমি অন্তত মনে করি না। তবে যা বলছিলাম, এ অভ্যাস সবার উপযোগী না। প্রত্যেকের নিজস্ব ধরন রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই নিজ লক্ষ্য এবং ধরন অনুযায়ী পড়ালেখার অভ্যাস ঠিক করে নেওয়া ভালো। কারণ যিনি সাহিত্য পড়বেন তাঁর প্রয়োজন এবং যিনি ডাক্তারী পড়বেন তাঁর প্রয়োজন এক হবে না। এটা সবারই খেয়াল রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল সম্ভবতঃ ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে এবং একই ধরনের টাইট রুটিনের পরীক্ষা। পরীক্ষা ভালোই দিচ্ছিলাম। আমার আরেকটি বদভ্যাস এর কথা এখানে বলি যা অনুসরণ করা উচিত হবে না কারো এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আমি সাধারণতঃ রিভিশন দেই না, পরীক্ষায় না, পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে প্রশ্ন মিলিয়ে দেখাও না। আমার আব্বা এনকারেজ করতেন যেন সব পরীক্ষা শেষে সবগুলো পত্র একবার দেখি। আমি তাই করেছিলাম এবং আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম প্রথম বিভাগ পাবার বিষয়ে।
পরীক্ষা শেষ হলে আবার ঘুরতে বের হলাম, আবারো ঢাকা দিনাজপুর, বগুড়া মহাস্থানগড় ঘুরে ঢাকায় এলাম। ট্রেনে বাহাদুরাবাদ ঘাট- ফুলছড়ি ঘাট (তিস্তামুখ ঘাট) হয়ে গিয়েছিলাম। যমুনায় তখন নতুন ফেরী, এমভি শেরে বাংলা, নতুন লাক্সারী প্যাসেঞ্জার ফেরী। ঢাকায় ফিরে এসে একটা নতুন আকর্ষণে পড়লাম। আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম আমার ‘পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া’ সম্পর্কে। তখন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক তরুণ ইমদাদুল হক মিলন। তাঁর প্রথম বই ‘ভালোবাসার গল্প’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। বই পড়ে তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম আর তাঁর তখনকার অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে তিনিও চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। চিঠিতেই পরিচয় হয়ে যায়। মে মাসে ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। মিলন তখন প্রকাশিতব্য সাপ্তাহিক রোববারে কাজ করেন। তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক বাংলা প্রকাশনার সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সে বাজারে ভাগ বসাতে ইত্তেফাক প্রকাশনার জবাব ছিল রোববার। দৈনিক বাংলা সরকারী পত্রিকা আর ইত্তেফাক সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। ফলে বন্ধের দিনগুলোতো বটেই অন্যান্য দিনেও রোববারের আড্ডায় সময় কাটতো আর একটি নতুন সাপ্তাহিক এর জন্ম প্রক্রিয়া দেখতাম। বন্ধের দিনগুলোতে সকালে মিলনের ৯, রজনী চৌধুরী লেন, গেন্ডারিয়ার বাসায় চলে যেতাম। বিরাট এক দালানের পেছনে অত্যন্ত সুন্দর খুঁটির উপর সেই কাঠের বাড়ি, ঢাকা শহরে অকল্পনীয়। ওখান থেকে একসঙ্গে আসতাম টিকাটুলীর ইত্তেফাকে।
১৯৭৮-৮০ সময়কালে ইমদাদুল হক মিলনের বহু লেখার প্রথম পাঠক আমি, সমালোচকও ছিলাম, আর চিতা রহস্যসহ অনেক লেখার কপিও হয়েছে আমার হাতে। ওখান থেকে তিনি যান ৫৪, দীননাথ সেন রোডের বাসায়। কিছুদিন আগে গেন্ডারিয়া গেলে বহু খুঁজে সেই রজনী চৌধুরী লেনের বাসা পেয়ে যাই, যা এখন টিসিএল কোম্পানীর কারখানা ও অফিস। ঐ সময়েই পরিচয় হয় লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক রাহাত খান, কবি রফিক আজাদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে অকেশনাল যোগাযোগ সবসময়ই বহাল ছিল। আরো পরিচয় হয় কবি আতাহার খান, সাংবাদিক আব্দুর রহমান, হোসনে আরা লতাসহ অনেকের সঙ্গে। আমার বন্ধু আবেদীন কাদের এর সঙ্গেও সম্ভবতঃ দেখা হয় সেখানে। দেখা হয় তখন চিঠিপত্র কলামে লিখে সবার পরিচিত তসলিমা নাসরিন এর সঙ্গেও। ১ জুন ১৯৭৮ রোববার এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় আমানুল হকের পেঁপে পাতার ফাঁকে বের হয়ে থাকা একটি মুখের ছবি প্রচ্ছদে ছেপে। ১৯৭৮ এর আর একটি স্মৃতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান যুব ফুটবল এর চূড়ান্ত পর্বের খেলা দেখা। বাংলাদেশের সেরা তরুণ খেলোয়াড় যারা আবাহনী মোহামেডানে খেলে তাদের খেলা মাঠে বসে দেখা। তখন আমার প্রিয় খেলোয়াড় আবাহনীর রাইট উইং ব্যাক টুটুল, দেওয়ান শফিউল আরেফিন।
আগস্ট ১৯৭৮ এর মাঝামাঝি আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট হয়। ঐদিন আমি ভ্রমনে ছিলাম, রাতে হবিগঞ্জে পৌঁছাই ফলে কোন খোঁজ নিতে পারছিলাম না। পরদিনও লাখাই যাই জরুরি কাজে। সারাক্ষন টেনশন কাজ করছিল যে কি হবে। রাতে ছিলাম নানাবাড়ীতে এবং রাত ন’টার সময় খবর এলো একেবারে পত্রিকাসহ, কারণ পত্রিকায় নামসহ রেজাল্ট ছেপেছে। অর্থাৎ আমি শুধু প্রথম বিভাগ না, কুমিল্লা বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছি। শব্দটা এখন প্রচলিত না। তখন বোর্ডে মেধা তালিকা থাকতো এবং বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ও কৃষিতে আলাদা মেধা তালিকা থাকতো। সম্মিলিত মেধা তালিকাও করা হতো আবার মেয়েদেরও আলাদা মেধা তালিকা থাকতো। আমি ১৯৭৮ সালে কুমিল্লা বোর্ডে মানবিক বিভাগে সপ্তম হই। আমাদের সময় বোর্ডে প্রথম হয় সাফাত সাত্তার, এসএসসিতে সে প্রথম বিভাগ পেলেও মেধাতালিকায় ২০ এর মধ্যে ছিল না। এসএসসি’র প্রথম ফিরোজ খানকে ৫০ নাম্বারের ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে সে প্রথম হয়। আমি এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে এইচএসসিতে বর্তমান ১৫ জেলাতে সপ্তম। মজা হলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সিভিল সার্ভিসে ব্যাচমেট মোঃ নজিবুর রহমানও এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে একই বছর এইচএসসিতে অষ্টম হয়েছিল। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় টপ টেনে যাবার অন্তত দুটো নজির ঐ বছর ছিল। এ কথাটা আমি পরবর্তী জীবনে, বিশেষ করে জেলা প্রশাসক থাকাকালে বহু স্কুল কলেজে শেয়ার করেছি যে একটি পরীক্ষায় খারাপ করা মানে জীবনের শেষ নয়, সুযোগের অনেকগুলো দরজা সামনে থাকে। নির্ভর করে আমি ঐ সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারছি কি না! আমার ক্ষেত্রে এইচএসসি’র এই ফল আমার পরবর্তী লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লোক প্রশাসন বিভাগে ভর্তি হওয়াকে সহজ করে দেয়। ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আমাকে কিছু বলতে হচ্ছে না কারণ আমাদের সময় ভর্তি প্রক্রিয়া ছিল নম্বর ভিত্তিক। কোন লিখিত পরীক্ষা ছিল না, একজন প্রার্থী পাঁচটি বিষয়ে আবেদন করতে পারতো এবং নম্বর ভিত্তিক বিভাগ ভিত্তিক মেধা তালিকা অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়েছিল।