শহর রক্ষা বাঁধ ঝুকিপূর্ণ হলে রামপুর এলাকা দিয়ে বাইপাসের মাধ্যমে খোয়াই নদীর পানি করাঙ্গী নদীতে ফেলার পরিকল্পনা
এসএম সুরুজ আলী ॥ ১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হবে ‘খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প’। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্প বাস্তাবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প বায়স্তবায়নের স্ক্যাচম্যাপ তৈরি করেছে। এর মধ্যে কি কি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে তা জানতে হবিগঞ্জ শহরবাসী অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো। বৃহত্তর এ প্রকল্পে হবিগঞ্জের দুঃখ বলে খ্যাত খোয়াই নদীর বাল্লা থেকে লাখাই’র ফরিদপুর পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ৪৫ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হবে। শুধু তাই নয়, খোয়াই নদী বর্তমানে মানুষের আতংক হলেও সেই নদী সংস্কারের পর মানুষের আশির্বাদ হয়ে দাঁড়াবে বলে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের আশাবাদ। নদীর পানি থেকে উৎপাদিত পলি সংগ্রহ করে কৃষকদের জমিতে দিয়ে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। এ হিসেবে নদীর বিভিন্ন স্থানে পলি সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হবে। পরবর্তীতে তা বাজারজাত করা হবে। এমন পরিকল্পনাই নিয়েছে সরকার। নদীর ওই বাঁধের সাধারণ স্থায়িত্ব ৩০/৩৫ বছর হলেও এর স্থায়িত্ব হবে ১শ’ বছর।
পাশাপাশি হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের সামন থেকে নাতিরাবাদ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার পুরাতন খোয়াই নদীকে সংস্কার করে নান্দনিক করা হবে। অনেকটা ঢাকার হাতিরঝিলের মতো। অনেকটা লেকের মতো হবে। নদীর দু’পাড় উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এতে মানুষের চলাচলের পরিচ্ছন্ন রাস্তা করা হবে। সেখানে বিভিন্ন প্রকার ফুলসহ নানান প্রজাতির গাছ-গাছালি লাগানো হবে। মানুষের বসার স্থান তৈরি করা হবে। অবসর সময়ে সেখানে পরিবার পরিজন নিয়ে লোকজন সময় কাটাতে পারবেন। নদীর পানি যাতে নষ্ট না হওয়ায় সে ব্যবস্থা করা হবে। নদীর উপরে যে কয়েকটি ছোট ছোট ব্রীজ-কালভার্ট রয়েছে সেগুলো ভেঙ্গে বড় ব্রীজ নির্মাণ করা হবে। মোট ৫টি ব্রীজ নির্মাণ করা হবে। পরবর্তীতে হবিগঞ্জ পৌরসভা সেখানে পার্ক ও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পুরাতন খোয়াই নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। সেখানে সরকারি কোন স্থাপনা থাকলে প্রয়োজনে পর্যায়ক্রমে তাও সরিয়ে নেয়া হবে। মূল কথা হলোও শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তাই করবে।
গত ৪ জুলাই খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পে প্রস্তাবনা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক হবিগঞ্জের নতুন ও পুরাতন খোয়াই নদী পরিদর্শনে আসলে এসব বিষয় তাকে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা অবগত করেন। এর আগে ২০১৮ সালের হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখা ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, হবিগঞ্জ শহরের খোয়াই নদীর বাঁধটি অনেক পুরাতন এবং শহরের অবস্থান বাঁধের উচ্চতা থেকে আনুমানিক ১৫ ফুট নিচে। ওই বছরের ১৫ জুন রাতে খোয়াই নদীর পানি শহরের কামড়াপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ২৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট অস্থায়ীভাবে মেরামত করা হলেও বাঁধটি রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। কোন কারণে শহরের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে পুরো শহর প্লাবিত হবে এবং রাষ্টীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। এ কারণে খোয়াই নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ শহর রক্ষা বাঁধটি নতুন করে সঠিক উচ্চতায় নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখা’র উপ-সচিব মো: শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ খোয়াই নদী’র বাঁধ নির্মাণসহ নদী সংস্কারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব আকারে উপস্থাপন করেন। এ প্রেক্ষিতে ওই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন করেন। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য উপ-সচিব মো: শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী সিলেটের বাপাউবো উত্তর-পর্বাঞ্চল প্রকৌশলীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি প্রেরণ করেন। এসব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রশাসন খোয়াইকে অভিশাপ মুক্ত ও নদী রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রাথমিক ভাবে শহরের খোয়াই নদীর ভাবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন। পরবর্তীতে শহরকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতেও জেলা প্রশাসন বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়। এর অংশ হিসেবে শহরের বাইপাস সড়কের দু’পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসন পরিচ্ছন্ন হবিগঞ্জ গড়ার লক্ষ্যে এক সভা করে। সভায় জানানো হয়, খোয়াই নদীকে নান্দনিক করতে ১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ প্রকল্পে কি কি বাস্তবায়ন হবে তা পুরোপরি জানানো হয়নি। এ প্রকল্পে কি কি বাস্তবায়ন হবে সেই বিষয়ে হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাওহিদুল ইসলামের সাথে এ প্রতিনিধির কথা হলে তিনি জানান, খোয়াই নদী হবিগঞ্জের দুঃখ হিসেবে পরিচিত। হবিগঞ্জবাসীরর দুঃখ লাঘব করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। তাই এই খোয়াই নদীর পুরো সিস্টেমটা উন্নত করার জন্য আমরা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। নতুন ও পুরাতন খোয়াই নদীর উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আমরা স্ক্যাচম্যাপ তৈরী করে গত ৪জুলাই পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। এ প্রেক্ষিতে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীও এসে খোয়াই নদী পরিদর্শন করেছেন। তিনি খোয়াই নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন। গত রবিবারও মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেছি। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে পরামর্শ সভায় বসবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল একনেকে প্রেরণ করা হবে। একনেক থেকে অনুমোদন হওয়ার পরই প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ শুরু হবে। উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে নদীর দু’পাড়ের অবৈধ দখলদারদের জেলা প্রশাসনের নির্দেশে উচ্ছেদ করা হবে। নদী পাড়ে সরকারি স্থাপনা থাকলে কি করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারি স্থাপনা যদি তাকে তাহলে জেলা প্রশাসন পর্যায়ক্রমে সেগুলো অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বাল্লা সীমান্ত এলাকা থেকে খোয়াই নদীর লাখাইর ফরিদপুর পর্যন্ত প্রায় ৯০কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। নদীর দুই পাড় ৩ থেকে ৫ফুট উচু হবে। বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ব্লক বসানো হবে। প্রকল্পের কাজ তদারকি করার জন্য একজন প্রকল্প পরিচালক মনোনীত করা হবে। আমরা এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে ৪ বছরে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর যদি বড় ধরণের কোন বন্যা হয় আর খোয়াই নদীতে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তাহলে রামপুর এলাকা দিয়ে বাইপাসের মাধ্যমে খোয়াই নদী পানি নেয়ার রাস্তা তৈরি করে করাঙ্গী নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করা হবে এমন পরিকল্পনাও আমাদের হাতে রয়েছে।
পাশাপাশি হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের সামন থেকে নাতিরাবাদ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার পুরাতন খোয়াই নদীকে সংস্কার করে নান্দনিক করা হবে। অর্থাৎ ঢাকার হাতিঝিল প্রকল্পের আদলে বাস্তবায়ন করা হবে এই প্রকল্প। প্রকল্পটি অনেকটা লেকের মতো হবে। নদীর দু’পাড় উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এতে মানুষের চলাচলের পরিচ্ছন্ন রাস্তা করা হবে। সেখানে বিভিন্ন প্রকার ফুলসহ নানান প্রজাতির গাছ-গাছালি লাগানো হবে। মানুষের বসার স্থান তৈরি করা হবে। অবসর সময়ে সেখানে পরিবার পরিজন নিয়ে লোকজন সময় কাটাতে পারবেন। নদীর পানি যাতে নষ্ট না হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নদীর উপরে যে কয়েকটি ছোট ছোট ব্রীজ/কালভার্ট রয়েছে, সেগুলো ভেঙ্গে বড় ব্রীজ নির্মাণ করা হবে। মোট ৫টি ব্রীজ নির্মাণ করা হবে। পরবর্তীতে হবিগঞ্জ পৌরসভা সেখানে পার্ক ও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করবে। মূল কথা হলো শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তাই করবে।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান মিজান জানান, হবিগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পুরাতন খোয়াই সংস্কারের। জেলা প্রশাসন হবিগঞ্জবাসীর কাক্সিক্ষত সেই দাবি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত হলে শহরে জলাবদ্ধতা থাকবে না। হবিগঞ্জ শহর পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। নদীতে বৃষ্টির পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নদীর দু’পাড়ের সৌন্দর্য্যও বৃদ্ধি পাবে। সেখানে সময় পেলেই লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে অবসর সময় কাটাতে পারবেন। হবিগঞ্জ পৌরসভা শহরের সৌন্দর্য্য রক্ষার জন্য সকল ধরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন জানান, ৫ কিলোমিটার পুরাতন খোয়াই নদীর অধিকাংশ জায়গা দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। সেখানে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে মাছ চাষ করছেন। আমরা খোয়াই নদী দখলমুক্ত করার জন্য অনেকদিন ধরে আন্দোলন করছি। কিন্তু খোয়াই নদী দখলমুক্ত হচ্ছে না। সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন খোয়াই নদীটি দখলমুক্ত করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমি মনে করি তা একটি মহতি উদ্যোগ। প্রকল্পটি যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয় আমরা এই কামনা করছি।